ক্ষয়
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ মে ২০২০, ১১:০৮ অপরাহ্ণ
আনোয়ার হোসেন মিছবাহ্:
তোমার মৃত্যু ফাঁসিতেই। হবে!গলায় তিলকটি ছুঁয়ে বলেছিলো দীপা।আট বছর তিন মাসের সম্পর্ক তাদের। এ রকম কথা এই প্রথম শোনা জয়ের। চমকে ওঠে জিজ্ঞেস করে সে-
-তিলক ফোঁটার জন্য ফাঁসিতেই মরতে হয় না কি?
কথাটা শোনা মাত্রই সমান্তরাল দাঁতে ঝলক হাসিটাই চালান করতে থাকে দীপা।অবাক হয়ে জয় ঝলক হাসি পর্যবেক্ষণে নামে।তার কাছে মনে হয় এ যেনো অনেক দিনের পরিচর্যার কাজ বৈ কিছু নয়।কোন একটি বেদনার কাতুকুতু হাসি এটি।দীর্ঘদিনের সম্পর্কের মাঝেও এ হাসি দেখেনি জয়। আজ দীপার জন্য দীপার অমন হাসি দেখতে পারছে জয়।
অফিস থেকে জোর করে এমসি কলেজে এনেছে দীপা।এটি দীপার বিবাহউত্তর প্রথম সাক্ষাত।এইতো বছর হলো বিয়ে হয়েছে দীপার।স্বামী আমেরিকার প্রবাসী।স্বামী পারিবারিক চোখে মানানসই।স্মার্ট,কথা বলায় জ্যুৎসই।কিন্তু ওসব পারিবারিকভাবে পছন্দনীয় লোকটিই দীপার বড়ো অসহ্য।বিয়ের পর থেকেই লোকটিকে রোবটের মতোই মনে হচ্ছে দীপার।অযাচিত কথন এবং অসামান্য চলাফেরা অস্বাভাবিক ঠেকে তার কাছে।বউয়ের সাথে স্বাভাবিক আচরণ ও করেনা লোকটি।যতো দিন যাচ্ছে রকমটির আয়তনও বেড়ে যাচ্ছে স্বামীর। রাত গাঢ় হলেই বারান্দার টান আসে তার।এ্যান্ড্রোয়েড ফোন নিয়ে বারান্দায় ফিসফিসানি প্রতিদিন কানে আসলেও পাত্তা দিতো না দীপা কিন্তু ফিসফিসানির অন্যপ্রান্তে যদি সীমার গলা শোনা যায় তখন পাত্তা দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না তার।বিয়ের পর থেকেই সীমাকে নিয়ে বের হতেন স্বামী প্রবর।হোটেল হিলটাউনের গেইটের আলো নিভলেই ফিরে আসতেন দুজন।বিয়ের আগে কথাগুলো শুনলেও পরিবারকে প্রাধান্যদিতেই এই অবস্থা তার।ব্যাপারটা শোনা অবধি থাকলেই ভালো হতো,যদি না হাতেনাতে ধরা পড়তো দুজন।।বান্ধবী নাজুর বিয়ের পার্টি থেকে ফিরতে একটু রাত হয়ে যাওয়াতেই হিলটাউনের গেটেই দেখা মেলে দুজনের।পরে জানতে পারে এ রকম আজকের নয় লম্বাদিনের।
আজ রাজন দীপার বিবাহবার্ষিকী। সে ই যে সকালেই সীমাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো,ফেরার নাম গন্ধ নেই।হয়তো গতদিনের মতো প্রেমিকার গাড়ে ভর দিয়ে আজও ফেরা হবে তার।
এ দৃশ্যটি বছরের মাথায় আর যেনো দেখতে না হয় সে ব্যবস্থাটিই করতে হয় তার।তাই জয়কে ফোন করে দীপা।
-জয়,তুমি কোথায়? একটু সময় হবে তোমার?
-কেনো কোন সমস্যা।
-না।দেখা হলেই বলবো।
-ফোনেইতো বলতে পারো।
-আমি আর পারছি না জয়।সিনিয়রটা আজও সীমাকে নিয়ে বেরিয়ে গেছে।
-কে,সীমা?
-রাজনের পুরাতন প্রেমিকা।
হয়তো একটু পরেই টলটলায়মান হয়ে ফিরবে বাসায়।আমি এর মুখ দেখতে চাই না আর।আমি কী করবো জয়?তুমি একটা কিছু করো।আমাকে বাঁচাও।
এমন আকুতি দীপার কন্ঠ থেকে বের হওয়া মাত্রই জয়ের মন টর্ণেডোর মতো সিদ্ধান্তের দিকে এগিয়ে যেতো।কিন্তু আজ তার মন নিশুতি রাতে আলোহীন আকাশের মতোই।বেদনার রক্তস্রোত শরীরের শোণিতে শোণিতে নিরবে হেঁটে চলেছে।বাঁচানোর মতো শক্তি বা সামর্থ্য তার নেই।কেননা দুই ভুবনে দুই বাসিন্দা বন্ধু চিরকাল হলেও রেললাইন সমান্তরাল নয়।দীপা জয় থেকে পাশের বাড়ির হলেও মন থেকে বহু পথ দূরে।০১৭১০-০০৯৩৫ নম্বরের ফোন কলটি কেটে দেয় সে।আবার কল আসে।আবার।এবার মোবাইলের সুইচটি অফ করে দেয় জয়।
এদিকে দীপা ঢাকা গ-১৩২ নম্বরের কারটি নিজেই ড্রাইভ করে নিজেই জয়ের অফিসে হানা দেয়।রুমে ঢুকেই টেবিলে রাখা মোবাইলের দিকে একপলক চাহনি দিয়েই জয়ের দিকে মুখ ফেরায় দীপা।দেখে টিবিলে মাথা রেখে জয় কেমন জানি ডুকরে ডুকরে উঠছে।আজকের দিনটা যদি মার্চ মাসের তিন তারিখ হতো তাহলে জয়ের অপমানটুকু কড়ায় গন্ডায় শোধ নিতো।কিন্তু আজ ইচ্ছে থাকলেও কিসের যেনো বাঁধা থমকে দিয়েছে তাকে।অবশ করে দিয়েছে হৃদয় চেতন।এবার দীপা জয়ের মাথায় আস্তে করে হাত রাখে।মাথা তোলে জয়।দীপা শাড়ির আঁচলে মুছে দেয় জল ছল ছল দুচোখ।যেনো চেনা অথচ কতো অচেনা সময়ের বাসিন্দা দুজন।আর পারে না জয়-চেয়ারের পেছনে রাখা স্যুটটি হাতে তুলে বেরিয়ে আসে।অন্যদিন হলে বলতো;চলো,চাংমাই চাইনিজে।দুপুরের লাঞ্চ সেরে ফিরবো বাসায়।কিন্তু আজ দীপার সিদ্ধান্তটিকেই ভরসা করে বললো;
-কোথায় যাবে দীপা?
কোন উত্তর নেই তার। নিজে গাড়িটি ড্রাইভ করে ব্যস্ততম রাস্তায়ও ৮০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালাচ্ছে সে!একটি নোহা গাড়ি প্রায় ধাক্কা দিতে দিতে এমসি কলেজে এসে ঢুকলো দুজন।
গেইটের ভেতর গাড়ি পার্ক করে বিবাহউত্তর স্থানটিকেই বেছে নেয় তারা।বসে বসেই পুরাতন কতকথায় মিহিয়ে যায় তাদের পিছু সময়ের কথা।কিন্তু আজকের মিহি কথা জয়ের কাছে বোধহীন কঠিন বলেই মনে হয়।এ রকম বোধহীন রসিকতায়ওতো পটু ছিলো না দীপা -তবু আজকে এমন করছে কেনো।কথার সাথে হাসির ছলক কেনো জানি আলগা পাগলামোই মনে হচ্ছে জয়ের।এর মধ্যে তিলক দেখে তোমার ফাঁসিতে মৃত্যু হবে-বলারই বা কী কারণ?
এবার হাসি থামিয়ে হঠাৎ করে জয়কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে দীপা।
-আমি আর বাঁচবো না জয়। তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারি না আমি।আমাকে তুমি গ্রহণ করো,নতুবা নিজ হাতে গলা টিপে মেরে ফেলো।আমি তোমাকে চাই।জীবনভর তোমাকে চাইবো।তোমাকে চাই।তোমাকে চাই জয়।তোমাকে চাই।আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও।বলো;ক্ষমা করেছো কি না?
বলে টাই ধরে টানতে থাকে।জয়েরও মন চায় মরে যাই।দীপা ছাড়া কেনোইবা জীবন তার।মন ভারি হয়ে ওঠে জয়ের।কী দিয়ে শান্তনা দেবে তার অন্তরতম প্রেয়সিকে?শান্তনার ভাষাটিও উবে গেছে।বুক থেকে দীপাকে ছাড়িয়ে দিয়ে বলে;
-চলো,তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিই।
রাজি হয় না দীপা।
-না।আজ আর বাসায় ফিরবো না।এখানেই থাকবো।
বলে অভিমান করে বসে থাকে বাঁকহীন,অপলক।
ঘড়ির কাঁটা যখন রাত এগারটার ঘরে,হঠাৎ করে একটি চার্জার টর্চের আলো দুজনের সমান্তরাল চোখে পড়ে।জয়ের বুকের উপর মুখ দেখে অপ্রস্তুত শাসনি সুর হাঁকায় দীপার স্বামী রাজন।একটু জোর।একটু শাসন করে দীপাকে বাসায় নিয়ে যায়।
রাতের ঘটনায় ফজর অবধি ঘুম হয়নি জয়ের।মনের দরোজায় বার বার কড়া নাড়ছে দীপার আকুতি ভরা মুখ।মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে শুনতে হয়তো এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে জয়।হঠাৎ বাড়ির উঠোনে সুরগুল শুনে ঘুম ভাঙ্গে তার।কেউ বলছে-হায়রে প্রেম!এই প্রেমের জন্যই জীবন দিলো এলাকার সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটি।মৃত্যুর জন্য একমাত্র দায়ি অপাত্রে কন্যাদান শুধু নয় আমেরিকা,লন্ডন মুখিতা।
কথাগুলো শুনতে শুনতে ছ্যাত করে উঠেছে জয়ের বুক। ধড়মরে করে বিছানা ছেড়ে বাইরে আসে জয়। দেখে রাজনের বাসায় একপাল পুলিশি পোষাক। এর মধ্যে সুরতহাল রিপোর্ট তৈরীতে ব্যাস্ত ইন্সপেক্টর জয়িতা। পাশে প্রিন্টের চাদরে মোড়া একটি পরিচিত লাশ।