সিলেটে প্রবাসীদের অপমানকারী ‘ফুলকলি’ একটি ‘মাখাল’ কোম্পানী
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ মার্চ ২০২০, ১০:১৮ অপরাহ্ণ
মুহাম্মদ তাজ উদ্দিন:
সিলেটের স্থানীয় ভাষায় ‘মাখাল’ একটি পরিচিত শব্দ। এর ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই, তবে যেহেতু ফুলকলি নামের মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ‘ফুলকলি’র মালিকের বাড়ি চট্টগ্রামে, সেহেতু‘মাখাল’ শব্দের ব্যাখ্যাটি তার কাছে দেয়া প্রয়োজন। সিলেটের স্থানীয় ভাষায় হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পূর্বাপর বিবেচনা না করে বোকার মত যে কাজ করে, তাকেই আমরা ‘মাখাল’ বলি।
আমাদের প্রবাসীদের নিয়ে ‘ফুলকলি’ এমন একটি কাজ করেছে, যাতে তাদেরকে অনায়াসে ‘মাখাল’ আখ্যা দেয়া যায়। গত ক’দিন ধরে ‘ফুলকলি’র একটি শোরুমের দরজায় সাঁটানো একটি ঘোষণার ছবি ঘুরছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, যেটিতে লেখা হয়েছে- ‘বিদেশি লোকের প্রবেশ নিষেধ’।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেটের গোলাপগঞ্জে ফুলকলির শোরুমের গ্লাসে লাগানো হয়েছে এই ঘোষণা সম্বলিত স্টিকার। ঘোষনা মর্মার্থ অনুধাবন করতে পারলে ধরে নিতে হবে- এখানে ‘বিদেশি’ বলতে প্রবাসীদের বোঝানো হয়েছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে প্রবাসীরা যাতে ঐ দোকানে প্রবেশ না করেন, সেজন্যই এই ঘোষণা দেয়া হয়েছে বলে অনুমিত হচ্ছে।
এ ধরনের অসৌজন্যমূলক ঘোষণার জন্য ‘ফুলকলি’কে মাখাল কোম্পানী হিসেবে আখ্যা দেয়া যায়। তারা এ ঘোষণাটি দিতে পারতো আরো পরিশীলিত ভাবে। প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেটে করোনা ঝুঁকি এড়াতে এ ধরনের সতর্কতামূলক ঘোষণা একেবারো অগ্রহণযোগ্য নয়। তবে, যে ভাষায় বা যেভাবে তারা এটি লিখেছে, তাতে প্রবাসীরা সংক্ষুব্ধ হয়েছেন। ক্ষুব্ধ হয়েছেন প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেটের অধিবাসীরাও। সিলেটবাসী অনেকে বিশেষ করে যুক্তরাজ্য প্রবাসীরা এ ছবিটি ফেসবুকে শেয়ার করে জানাচ্ছেন তাদের ক্ষোভের কথা।
গণামধ্যমের খবর থেকে জানা গেছে, গত ১৮ মার্চ পর্যন্ত শুধুমাত্র যুক্তরাজ্য থেকেই সিলেটে এসেছেন প্রায় ১৯ হাজার। সিলেটের আকাশ অবমুক্ত থাকায় বর্তমানে এই সংখ্যা ৩০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে বলে ধারণা। অর্থাৎ এ মুহূর্তে কমপক্ষে ৩০ হাজার যুক্তরাজ্য প্রবাসী সিলেটে অবস্থান করছেন। যুক্তরাষ্ট্র, ইতালী, কুয়েত, সৌদী আরবসহ বিশ্বেও নানা প্রান্ত থেকে আরো কয়েক হাজার প্রবাসী এসেছেন সিলেটে। সিলেটের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে এ চিত্র খুবই স্বাভাবিক।
প্রবাসীরা আমাদের স্বজন। আমাদের আত্মার পরমাত্মীয়। তারা দেশে আসলে সিলেটের মানুষ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষায় তাদেরকে ‘নবাবজাদা’র মতই বরণ করেন। তবে, সম্প্রতি প্রবাসীদের অনেকে দেশে এসে করোনা পরিস্থিতির নির্দেশনা মানছেন না। এটি আমাদের জন্য উদ্বেগের। প্রবাসীদের সবাইকে কমপক্ষে ১৪ দিনের জন্য ‘হোম কোয়ারেন্টাইনে’ থাকার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হলেও অনেকেই তা মানছেন না। তারা হোম কোয়ারেন্টাইনের শর্ত লঙ্ঘণ করে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
গণমাধ্যমে খবর দেখলাম, ওসমানীনগরে কয়েক জন প্রবাসী আবার মহাসমারোহে ষাড়ের লড়াইয়েরও আয়োজন করেছেন। অবশ্য, থানা পুলিশের হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত তা সফল হয়নি। হোম কোয়ারেন্টাইনের শর্ত না মানায় বিভিন্ন উপজেলায় অনেক প্রবাসীকে জরিমানাও গুনতে হয়েছে। প্রবাসীরা যখন বিলেতে বা বিদেশের মাটিতে থাকেন, তখন তারা আইন মেনে চলেন। কিন্তু, নিজ দেশে বা পিতৃভূমিতে বেড়াতে এসে তারা নিয়মের মধ্যে থাকতে চান না। আমরাও মনে করি, প্রবাসীরা বাংলাদেশে আসেন ছুটি কাটাতে। আত্মীয় স্বজনের সাথে সাক্ষাৎ করতে। হলিডে-তে আসলে একটু অনিয়ম হবে না- তা কি করে হয়?
কিন্তু, করোনা ভাইরাস সংক্রমণের মুখে পুরো বিশ্ব জুড়ে এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। যুক্তরাজ্যের খবর আমরা যতটুকু পাচ্ছি, সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশীরা নিজ উদ্যোগেই সেলফ কোয়ারেন্টাইনে চলে গেছেন। নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তার স্বার্থে তারা কঠোরভাবে শৃঙ্খলা মেনে চলছেন। তাহলে, বাংলাদেশে এসে তারা করোনা পরিস্থিতিতে কেন তারা নিয়ম মানবেন না।
গত ক’দিন ধরেই সিলেটের সকল অফিস আদালতে লোকজন যাতে কম যান সে জন্য স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। সম্প্রতি দেশে আসা প্রবাসীরা যাতে অফিস আদালতে উপস্থিত না হন, সেজন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকেও বার বার অনুরোধ জানানো হচ্ছে। আজ (বুধবার) দুপুরে বন্দরবাজার এলাকায় পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের মূল ফটকে মাইক বেঁধে এ সংক্রান্ত প্রচারণা চালানো হচ্ছে, যেখানে বার বার বিদেশ থেকে আসার লোকজনকে কমপক্ষে ১৪ দিন নিজ ঘরে অবস্থানের অনুরোধ জানানো হচ্ছে বলে শুনতে পেলাম।
কিন্তু, প্রবাসীরা সে সব অনুরোধ-উপরোধের তোয়াক্কা করছেন না। তারা সত্যি সত্যি ‘নবাবজাদা’র মত নবাবী চালে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। গত মঙ্গলবার সিলেটের যুগ্ম মহানগর ২য় আদালতে হঠাৎ করেই বিচারক উত্তেজিত হয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো এক ব্যক্তিকে ‘ইডিয়ট’ বলে সম্বোধন করছেন বলে শুনতে পেলাম। বিষয় কি জানতে চেয়ে যা শুনলাম তা ভয়াবহ। কাঠগড়ায় দাঁড়ানো ঐ ব্যক্তি নাকি বিমান বন্দর থেকে সরাসরি চলে এসেছেন জামিন নিতে। অথচ, বিমান বন্দরেই তার হাতে সিল দেয়া হয়েছে। অনুরোধ করা হয়েছে- ১৪ দিন নিজ ঘরে অবস্থানের। সার্বিকভাবে এই হলো পরিস্থিতি।
এ অবস্থায় প্রবাসী অধ্যুষিত গোলাপগঞ্জের এক দোকান মালিক জনস্বার্থে তার দোকানে প্রবাসীদের না আসার জন্য অনুরোধ জানালে দোষের কিছু নয়। কিন্তু, যে ভাষায় কুরুচিপূর্ণভাবে এ সাইনবোর্ডটি টাঙ্গানো হয়েছে, তা অপমানজনক-আক্রমণাত্মক।
সিলেটের জেলা পুলিশ সুপার ফরিদ উদ্দিন অত্যন্ত সজ্জন লোক। করোনা পরিস্থিতি ছাড়াও তার স্বল্পকালীন সিলেট অবস্থানকালে অনেকগুলো পদক্ষেপের মাধ্যমে তার জনসম্পৃক্ততা ও জনমুখীতার প্রমাণ রেখেছেন। করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় উপজেলা পর্যায়ে তার নানা উদ্যোগের খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণামধ্যমে এসেছে। আজ (বুধবার) সকালে কানাইঘাট থানার ওসি আব্দুল আহাদের ফেসবুক পেজে দেখলাম, পুলিশ সুপার কানাইঘাটে জীবাণুমুক্ত করার জন্য স্প্রে পাঠিয়েছেন। এই পুলিশ সুপার সাহেবের অফিসের সামনে আজ শুনলাম মাইকিং করা হচ্ছে অত্যন্ত মার্জিত ভাষায়।
প্রবাসীদের উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে- ‘বিদেশ থেকে আসা লোকজনকে কমপক্ষে ১৪ দিন জনবহুল স্থান এড়িয়ে নিজ বাড়িতে অবস্থানের অনুরোধ জানানো হচ্ছে। নিজের ও দেশে অবস্থানরত স্বজনদের নিরাপত্তার স্বার্থে এ নির্দেশনা কঠোরভাবে মেনে চলার অনুরোধ জানানো যাচ্ছে’।
গোলাপগঞ্জ ফুলকলি’র সাঁচানো স্টিকারে এভাবে মার্জিত ভাষায় দোকানে উপস্থিতি এড়ানোর জন্য প্রবাসীদের অনুরোধ জানানো যেত। কিন্তু, তারা সিলেটবাসীর পাল্স বুঝেনি। বুঝার কথাও না। কারণ, ফুলকলি সিলেটে এসেছে ব্যবসা করতে। প্রবাসী সিলেটী ও বিত্তবান সিলেটবাসীর পকেট কাটতেই তাদের আয়োজন। তাই, তারা যা করেছে ‘মাখাল’-এর মত করেছে।
চট্টগ্রাম ভিত্তিক ফুলকলি ফুডস্ এর অনেকগুলো শাখা রয়েছে সিলেটে। তাদের কারখানাও রয়েছে সিলেটে। পুরো সিলেট বিভাগ জুড়ে রয়েছে তাদের শোরুম। প্রতি বছরই এরা সিলেটের কোথাও না কোথাও নতুন একটি শাখা খুলে। তাদের এই শনৈ শনৈ উন্নতির পেছনে রয়েছে সিলেটবাসীর অবদান। দেশের আর কোন জেলা শহরে ফুলকলির এত শাখা আপনি খুঁজে পাবেন না। এমনকি খোদ চট্টগ্রামেও ফুলকলির এত শাখা আছে কি-না সন্দেহ। আগাগোড়া বেনিয়া ‘ফুলকলি’ সিলেট এসেছে ব্যবসা করতে। সিলেটের মাটি বা মানুষের সাথে এদের কোন সম্পর্ক নেই।
‘ফুলকলি’তে ঢুকলে আপনি শুনতে পাবেন চাটগাইয়া ভাষায় কথা বলছে তাদের সব লোক। এমনকি, এরা দোকানের সেলসম্যানও চট্টগ্রাম থেকে নিয়ে এসেছে। ফুলকলির বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক যখন সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ছাত্র ছিল, তখন তার সাথে আমার পরিচয় ছিল। সে দীর্ঘদিন সিলেটে থেকেছে। কিন্তু, সিলেটবাসীর পাল্স সে হয়তো বুঝতে পারেনি। আর তাই তার কোম্পানীর দৃষ্টতা হয়েছে সিলেটবাসীর সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণের।