প্রকৃতির আঙিনায় লাগলো শীতের কাঁপন
প্রকাশিত হয়েছে : ১:০১:৫৬,অপরাহ্ন ২৯ নভেম্বর ২০১৯
মো. শামছুল আলম:
“শীত এসেছে লাগলো কাঁপন, লাগলো দোলা প্রাণে
শীত এসেছে হিমেল হাওয়া, আনন্দ আর গানে
বিশাল মাঠে সরসে ফুলের অবাধ ছরাছরি,
ভ্রমরগুলো মধুর খোজে করছে ঘোরা-ঘুরি
শিউলি তলায় ভোর বেলায় ছেলে-মেয়ের মেলা
এই ফুলেতে কত শত গাথবে তারা মালা।”
গ্রীষ্ম-বর্ষার পর আসে শরৎ। কিছুটা পরে তা মিশে যায় হেমন্তে। শীতের অবস্থান হেমন্তের পরে এবং বসন্তের আগে। শীতকাল পৌষ ও মাঘ—এই দুই মাস হলেও এর শুরু কিছুটা আগে এবং শেষ হয় কিছুটা পরে। পৌষ ও মাঘ—এই দুই মাস নিয়ে শীতকাল। বাংলাদেশের ঋতুচক্রে অন্যান্য ঋতু থেকে শীতের বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ ভিন্ন।
শুষ্ক চেহারা আর হিমশীতল অনুভব নিয়ে আসে শীত। এ সময় গ্রামবাংলা যেন শীতের চাদর মুড়ি দেয়। ভোরবেলা ঘন কুয়াশার ধবল চাদরে ঢাকা থাকে। হিমেল হাওয়ায় হাড় কাঁপিয়ে শীত জেঁকে বসে। শীতের দাপটে প্রকৃতি নীরব হয়ে যায়। সবুজ প্রকৃতি রুক্ষ মূর্তি ধারণ করে। শীতের শুষ্কতায় অধিকাংশ গাছপালার পাতা ঝরে পড়তে থাকে। শীত তার চরম শুষ্কতার রূপ নিয়ে প্রকৃতির ওপর জেঁকে বসে। রুক্ষতা, তিক্ততা ও বিষাদের প্রতিমূর্তি হয়ে শীত আসে। শীতের তান্ডবে প্রকৃতি বিবর্ণ হয়ে পড়ে।
শীতকাল মানে চারপাশে মিহি কুয়াশার বৃষ্টি, আধ শুকনো জলাশয়ে হাজার হাজার পরিযায়ী রঙবাহারি পাখির ছন্দ তোলা নাচ, হিমেল হাওয়ায় মিষ্টি রোদ্দুরের প্রিয়তম পরশ, গাঢ় সবুজের পাতা চুইয়ে টুপটাপ শিশির বিন্দু খসে পড়ে দূর্বাঘাসের ওপর। বিস্তীর্ণ দিগন্তে শরষের ক্ষেতের হলুদ গালিচা কিংবা ফুলে ফুলে ভ্রমরের আনন্দনৃত্য প্রকৃতিকে সাজায় নতুন সাজে। সূর্যের আলোতে সেই শিশির বিন্দু যখন এক মোহনীয় দৃশ্যের অবতারণা করে তখন শীতের প্রকৃতি হয়ে ওঠে এক অপার্থিব সৌন্দর্যের আধার। শীত এমনই এক ঋতু যে নিজের যবুথবু অবস্থার মধ্যেও মানুষকে কাছে ডেকে নেয়, তার অপরূপ রূপে মোহাবিষ্ট করে। চিরাচরিত প্রথা ভেঙে রূপ বদলে পাল্টে যায় অন্য এক আদলে। আর এটাই হল শীতের বৈশিষ্ট্য।
পৌষ-মাঘ শীতকাল হলেও অগ্রহায়ণ হলো শীতের মোহনা। এসময় রিক্ত প্রকৃতিকে আমরা নতুন করে আবিষ্কার করি। এক অদ্ভুত আচ্ছন্নতা ঘিরে রাখে চারপাশ। দিনের সূর্য ঢেলে দেয় মায়াবি রোদ। রাতের আকাশে রূপালি তারা খচিত শুভ্রতা। চাঁদের ধবধবে দুধ সাদা জোছনা। পূর্ণিমা চাঁদ হয়ে ওঠে শিশির ধোয়া রূপার থালা।
খালবিল থেকে সবে বর্ষার জল শুকাতে শুরু করেছে। আকাশে ছন্নছাড়া নীল মেঘের ভেলা। কাঁশবনের শন শন শব্দ আর পাখ-পাখালির কিচির-মিচিরে মুখর জনপদ। পরাণে তীব্র শীস দেয় কোনো এক আকুলতা। গ্রামাঞ্চলে শুরু হয়েছে মাছ ধরার উৎসব। এ সময়টাতে খাল-বিল-নদ-নদীর পানি কমে যায়। শত্র“তা ভুলে জড়াজড়ি করে বেঁচে থাকে জলজপ্রাণী। কিন্তু মানুষের অসচেতনতার কারণে মাছ শিকারের নামে এসময় জলাশয় সেচ দিয়ে প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় হাজার হাজার জলজপ্রাণী ধ্বংস করা হয়। আর এর ফলস্বরূপ বর্তমানে আমাদের দেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ছোট-বড় দেশী প্রজাতির অনেক মাছ।
শীত নামে নগরে, শহরে, ছোট-বড় বন্দরে-বাজারে-গঞ্জে; কিন্তু সবুজ গ্রামবাংলার প্রকৃতিজুড়ে যে শীত নামে তার রূপই আলাদা। বাগানে ফুটে রংবাহারি মওসুমী ফুল। ফলের দোকানে কমলালেবুর পাহাড়। সব্জীবাজারে ফুলকপি, পালং, মটরশুঁটি। মিষ্টির দোকানে নলেন গুড়ের সন্দেশ। ভোরেরবেলা কুয়াশা ভেদ করে এগিয়ে চলে সোয়েটার, মাফলার, গরম টুপি, নরম শাল। যে রূপসী আর কেউ নয়। রূপের চঞ্চল পরিদের সচকিত পায়ে বাংলার মাঠে, পথে, গাছপালার নিভৃত জগতে এই সময় যেন হেঁটে বেড়াতে দেখি। এ সময় জীবন ভরে ওঠে নিরুদ্বেগ প্রসন্নতায়, শস্যের অপর্যাপ্ত সম্ভারে, শীর্ণতোয়া নদীরা চিকচিক করতে থাকে স্বচ্ছ রূপালি ধারায়, বকেরা ওড়াউড়ি করে, বিস্তীর্ণ জলাভূমির ধারে অতিথি পাখিরা দীর্ঘদিনের জন্য ঘর বাঁধে।
“শৈত্য হাওয়া ঘিরিয়াছে জাল ফেলি
মানুষ আর প্রকৃতি নিদ্রাময় চোখ মেলি
দেখিতেছে –
গাঢ় ধূম্রের কুন্ডলী উদ্বেলিছে হেথা,
শীত নিবারিতে উঠোনে উঠোনে
কাষ্ঠবহ্নি অনিবার উঠিতেছে জ্বলি।”
বাংলার দুঃখি মাঠঘাট ছুঁয়ে , ক্ষীন হয়ে আসা হিজলের বনে হীম মেখে, মরে যাওয়া ধরলার জলে শিরশির কাঁপন তুলে হিমালয় হাওয়া ছায়া ফেলে যায় আমাদের গাঁয়ে । হেমন্তের শেষ বিকেলের আলো ফুরিয়ে গেলে, শীতের সজারু কাঁটা ধীরে ধীরে গেঁথে ফেলে উত্তরের জনপদ ।
“মাঘের শীত বাঘের গায়” প্রবাদটি যেন হুঙ্কার ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে লোকালয়ে । হাড় কাঁপনো শীতে বাংলার আদুল শিশুটি গুটিশুটি মেরে উষ্ণতা খোঁজে শীর্ণকায়া মায়ের কোলে । জনপদে এই উষ্ণতার ছোঁয়া চিত্রিত হয়ে উঠে রঙে রঙে।
নগরজীবনকে শীত সকাল কুয়াশায় তেমন ঢাকে না। ইট-পাথরের দালান-কোঠায় এতটা ঠাসাঠাসি, এখানে কুয়াশা নামার জায়গা কই? কুয়াশারা আনন্দ করবে কীভাবে? কীভাবে ঝরবে কুয়াশার গুঁড়ি? মাঝে মাঝে কিছু কুয়াশা নামে বটে। কিন্তু সে কুয়াশা গ্রামে কুয়াশার মতো সচ্ছল নয়। নগরের ধুলাবালি মেশানো একধরনের ধোঁয়ার মতো কুয়াশাগুলো নিষপ্রাণ। শীতও ক্ষীণ হয়ে প্রবেশ করে শহরে। মাত্র ক’টি দিন শীত নামে। কিন্তু শহরের মানুষের শীতের আয়োজন অনেক বেশি। অনেক রকম সুযোগ-সুবিধা। গরম কাপড়-চোপড় মেলে সহজেই। কুয়াশা শীত ঠেকানোর পদ্ধতিও সহজ।
শীতকাল উপভোগ্য হলেও এই মৌসুমটাতে নানা রোগব্যাধির প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে ঠান্ডাজনিত নানা স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দেয়। এ সময়টাতে শরীরের প্রতি বাড়তি যত্ন নিতে নয়। যাতে ঠান্ডাজনিত রোগব্যাধি থেকে সহজেই রক্ষা পাওয়া যায়। এ সময় সর্দি-কাশি, গলায় খুশখুশ ভাব, নাক বন্ধ হওয়া, নাক দিয়ে অনবরত পানি ঝরা এবং ঘন ঘন হাঁচি, ভাইরাসজনিত জ্বর, শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা, শরীর ম্যাজম্যাজ করা, দুর্বল লাগা ও খাদ্যে অরুচিসহ অন্যান্য উপসর্গ দেখা দেয়। শীতকালে নাক, কান ও গলায়ও বিভিন্ন সমস্যা হয়ে থাকে। শীতে ত্বক শুষ্ক হয়, ত্বক ফেটে যায় এবং একজিমা, চুলকানির মতো চর্মরোগ দেখা দেয়।
তাই, আসুন আমরা শীত উপভোগ করি ও নিজে নিরাপদে থাকি এবং গরীব-দুঃখী-অসহায় মানুষদের সহায়তায় এগিয়ে আসি।
লেখকঃ সাবেক অফিসার, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিঃ।