সিলেটে নিখোঁজ শামীমের লাশ মিললো কুমিল্লায়, নানা নাটকীয়তা
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ আগস্ট ২০১৯, ১২:২৯ পূর্বাহ্ণ
ওয়েছ খছরু:
সিলেটের এম্বুলেন্স চালক শামীমের গলিত লাশ মিললো কুমিল্লার মুরাদনগরে। লাশের শরীরে কোনো কাপড় ছিল না। দাহ্য পদার্থ দিয়ে লাশ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। ৬ দিন নিখোঁজ থাকার পর মুরাদনগরের পাহাড়পুরের একটি ডোবায় মিলেছে তার লাশ। আর লাশ উদ্ধারের পর শুরু হয় নানা নাটকীয়তা। শামীমের শ্বশুরবাড়ি ফেনীর সোনাগাজীতে। খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক ছুটে এসেছিলেন তার সম্বন্ধী মুজিবুর রহমান। তিনি কুমিল্লা হাসপাতালে এসে লাশ দেখে জানান- এটি শামীমের লাশ নয়। ফলে মুরাদনগর থানা পুলিশ লাশটি আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের কাছে দিলে তারা বেওয়ারিশ হিসেবে লাশটি দাফন করে। ওদিকে খবর পেয়ে সিলেট থেকে ছুটে যাওয়া তার ভাই শাহীন আহমদ দাফনের পর মুরাদনগর পৌঁছে ছবি দেখে লাশটি তার ভাই শামীমের বলে শনাক্ত করেছেন। শাহীনের ধারণা, সম্পত্তির লোভে শ্বশুরবাড়ির লোকজন শামীমকে খুন করতে পারে। সিলেটের অ্যাম্বুলেন্স চালক শামীম আহমদ। তার বাড়ি সিলেট নগরীর ৫০ ভাতালিয়া আবাসিক এলাকায়। পিতা হিরন মিয়া। দীর্ঘদিন ধরে শামীম আহমদ সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বাইরের বিভিন্ন প্রাইভেট কোম্পানির অ্যাম্বুলেন্স চালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। দীর্ঘদিন শামীম শাহজালাল অ্যাম্বুলেন্সের চালক ছিলেন। বর্তমানে আদর্শ অ্যাম্বুলেন্সের চালক তিনি। ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকায় শামীম সবার কাছে পরিচিত। ২০০৭ সালের দিকে শামীম তার ভাইদের সঙ্গে রাগ করে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হন। এরপর থেকে তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। পরিবারের লোকজন জানান, নিরুদ্দেশ হওয়ার পর তারা শামীমকে অনেক খোঁজাখুঁজি করেন। বছর খানেক পর তারা জানতে পারেন শামীম ফেনীর সোনাগাজী উপজেলায় চলে গেছে। সেখানে গিয়ে সে বিয়েও করেছে। স্থানীয় চরকৃষ্ণদা গ্রামে তার শ্বশুরবাড়ি। সেখানেই সে বসবাস করছে। খবর পেয়ে সিলেটের ভাতালিয়া থেকে ভাইরা গিয়ে তাকে বউসহ সিলেটে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। এরপর থেকে শামীম ভাতালিয়ায় তার পিতার বাড়িতেই বসবাস করছিল। একপর্যায়ে শামীম ভাইদের ছেড়ে আলাদা বাসা নেয়। নগরীর ঘাষিটুলা মোকাববাজার এলাকার একটি বাসায় স্ত্রী, সন্তানসহ বসবাস করতো। আর হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স চালাতো। এদিকে সিলেটের আয় করা টাকা দিয়ে শামীম তার শ্বশুরবাড়িতে ২২শতক জমি ক্রয় করেন। সম্প্রতি সময়ে ওই জমিতে বসতবাড়িও নির্মাণ করেছেন। খুব শিগগিরই স্ত্রী, সন্তানসহ স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য সোনাগাজীতে চলে যাওয়ার কথা ছিল শামীমের। এ কারণে নতুন বাসায় বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে তিনি গত ঈদুল আজহার দিন রাতে স্ত্রী সন্তানদের সিলেটের বাসায় রেখে সোনাগাজী চলে যান। সেখানে গিয়ে তিনি বিদ্যুৎ সংযোগের প্রয়োজনীয় কাজ সেরে ১৪ই আগস্ট রাত ১১টার সিলেটের ট্রেন ধরতে শ্বশুরবাড়ি থেকে রওয়ানা দেন। পরিবারের সদস্যরা জানান, সন্ধ্যায় শ্বশুরবাড়ি থেকে বের হয়ে তিনি ফেনী রেলওয়ে স্টেশনে আসেন। সেখানে এসে রাত ৮টার দিকে তিনি সিলেটে থাকা স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। এবং জানান, রাত ১১টার ট্রেনে তিনি সিলেটের পথে রওয়ানা দেবেন। সোয়া ৮টার দিকে স্ত্রীর সঙ্গে তার আরেকবার কথা হয়। এরপর থেকে শামীম আহমদের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তার সঙ্গে সিলেট কিংবা সোনাগাজীর স্বজনরা সংযোগ স্থাপন করতে পারেন নি। এদিকে শামীমের কোনো খোঁজ না পেয়ে সিলেটে স্বজনরা ব্যাকুল হয়ে উঠেন। তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে অনুরোধ জানান। তাদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে শামীমের সম্বন্ধী মুজিবুর রহমান ফেনী মডেল থানায় শামীম নিখোঁজ হয়েছে জানিয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। এদিকে নিখোঁজের প্রায় ৬ দিন পর গত ২০শে আগস্ট রাতে কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার পাহাড়পুরের কান্তিবাজারের একটি পুকুরে যুবকের গলিত লাশ পাওয়া যায়। ওই লাশের মুখমণ্ডল বিকৃত। দাহ্য পদার্থ দিয়ে শরীর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। পরনে কোনো কাপড় ছিল না। পুলিশ লাশ উদ্ধারের পর সোনাগাজী থানার পুলিশের মাধ্যমে খবর পান সাধারণ ডায়েরির বাদী মুজিবুর রহমান। তিনি বুধবার সকালে আসেন কুমিল্লা জেলা হাসপাতালে। সেখানেই ছিল শামীমের লাশ। প্রায় ৮০ ভাগ বিকৃত লাশ দেখে এটি শামীমের লাশ নয় বলে পুলিশকে জানিয়ে দেন। ফলে মুরাদনগর থানা পুলিশ ময়নাতদন্ত সম্পন্নের পর লাশ আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের কর্মকর্তাদের কাছে দিলে তারা বেওয়ারিশ হিসেবে তাদের নিজস্ব গোরস্থানে শামীমের লাশ দাফন করেন। এদিকে লাশ উদ্ধারের খবর পেয়ে বুধবার সকালে কুমিল্লার পথে রওয়ানা দেন সিলেটের ভাতালিয়ায় থাকা শামীমের ভাই শাহীন ও তার স্বজনরা। তারা কুমিল্লা পৌঁছানো আগেই লাশ দাফন করা হয়। ওদিকে সম্বন্ধী মুজিবুর রহমান লাশ শামীমের নয় জানিয়ে সিলেটের স্বজনদের সঙ্গে দেখা না করেই তিনি ফেনী চলে যান। এরপর থেকে তিনি শামীমের ভাইদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। শামীমের ভাই শাহীন আহমদ গতকাল মানবজমিনকে জানিয়েছেন, মুরাদনগর থানা পুলিশ লাশের যে ছবি দেখিয়েছে সেটি দেখে আমরা প্রায় নিশ্চিত হয়েছি, দাফন করা লাশটি শামীমের। আমরা যাওয়ার আগে মুজিবুর রহমানের কথায় তারা লাশ দাফন করে ফেলেছিল। এ কারণে লাশ দেখতে পারিনি। তিনি বলেন, শামীমের সম্বন্ধী মুজিবুর রহমান ঘটনার ৫ দিন পর থানায় জিডি করেন। এরপর তিনি সিলেটের পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না করেই লাশ শামীমের নয় জানিয়ে পুলিশকে বিভ্রান্ত করেছেন। এ কারণে শামীম খুনের বিষয়টি রহস্যময় হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, শামীম তার শ্বশুরবাড়িতে জমি কিনে বাড়ি বানিয়েছে। আর ওই জমির কারণে শামীমকে অপহরণ করে খুন করা হতে পারে। গতকাল বৃহস্পতিবার তারা কুমিল্লা থেকে সিলেটের পথে রওয়ানা দিয়েছেন বলে জানান শাহীন। বলেন, সিলেট ফিরেই পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবেন। এদিকে, মুরাদনগর থানার এসআই গোফরান আহমদ জানিয়েছেন, জিডির বাদী মুুজিবুর শামীমের লাশ শনাক্ত করতে পারেন নি। আমরা জানতাম না শামীমের ভাইরা সিলেট থেকে আসছেন। জানলে আমরা লাশ সমাহিত করতাম না। সিলেট থেকে শামীমের ভাই এসে ছবি দেখে লাশ শনাক্ত করেছেন। এরপরও বিকৃত লাশ থাকায় আমরা এখন ডিএনএ টেস্টের প্রস্তুতি নিচ্ছি। লাশটি শামীমের কী না- সেটি এখন নির্ণয় করা প্রয়োজন। পরে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।