ডেঙ্গুঃ আতঙ্ক নয়, সচেতনতা জরুরী
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ আগস্ট ২০১৯, ১০:২০ অপরাহ্ণ
বর্তমানে দেশ জুড়ে ডেঙ্গু নিয়ে একধরণের আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ বছর হাজার হাজার মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন এবং এখনো হচ্ছেন। অনেকে মারাও গেছেন। যদিও সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা করা গেলে এই রোগে মৃত্যু হয়না বললেই চলে।
ডেঙ্গু কি?
ডেঙ্গু এক ধরনের ভাইরাস ঘটিত রোগ। ডেঙ্গু ভাইরাস দিয়ে এই রোগ হয়ে থাকে। বাংলাদেশে ৪ ধরনের ডেঙ্গু ভাইরাস রয়েছে। এক ধরনের ডেঙ্গু ভাইরাস দিয়ে আক্রান্ত হবার পর একই ব্যক্তি অন্য তিনটি ভাইরাস দিয়েও আক্রান্ত হতে পারেন। অর্থাৎ একজন মানুষ ৪ ধরনের ডেঙ্গু ভাইরাস দিয়ে ৪ বার ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হতে পারেন। এই ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করার ৪-১০ দিন পর ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেয়ে থাকে।
ডেঙ্গু কিভাবে ছড়ায়?
ডেঙ্গু ভাইরাস এডিস নামক মশার কামড়ের মাধ্যমে আক্রান্ত মানুষ থেকে সুস্থ্য মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। যখন একটি সুস্থ্য এডিস মশা ডেঙ্গু আক্রান্ত কোনো মানুষকে কামড় দেয়, তখন রক্তের মাধ্যমে ডেঙ্গু ভাইরাস মশার শরীরে প্রবেশ করে। এরপর যখন এই মশাটি অন্য কোনো সুস্থ্য মানুষকে কামড় দেয়, তখনি ভাইরাসটি সেই সুস্থ্য মানুষের শরীরে প্রবেশ করে এবং ধীরে ধীরে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। একইসাথে সেই আক্রান্ত এডিস মশার ডিম থেকে যতগুলো মশার জন্ম হবে, তারাও ডেঙ্গু ভাইরাসের জীবাণু বহন করে থাকে। সেই কারণেই ডেঙ্গু ভাইরাস খুব দ্রুত সারা বিশ্ব জুড়েই ছড়িয়ে পড়ছে।
ডেঙ্গু জ্বর কখন হয়?
সাধারণত মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত, যখন গরম থাকে এবং বৃষ্টিপাত হয়, তখনই ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদূর্ভাব দেখা দেয়। শীতকালে এই জ্বর খুব একটা হয়না। শীতকালে ডেঙ্গু মশার লার্ভা থেকে পরিপূর্ণ মশার জন্ম হয়না। কিন্তু বর্ষাকালে বৃষ্টির পানিতে এই লার্ভাগুলো ৪-৫ দিন থাকলেই পূর্ণাঙ্গ মশার জন্ম হয়। বৃষ্টির পানি না পেলে এই মশার লার্ভা অনেকদিন পর্যন্ত জীবিত অবস্থায় থাকতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বরে কারা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন?
সাধারণত শহরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় যেখানে পরিত্যক্ত টায়ার, নারকেলের খোসা, অব্যবহৃত কৌটা, ফুলের টব ইত্যাদিতে পরিষ্কার পানি জমে, সেখানেই এডিস মশা বংশবৃদ্ধি করে। তাই ডেঙ্গু জ্বরও এইসব এলাকাতে বেশি হয়ে থাকে। এই বছর দেশের সব কয়টি জেলাতেই ডেঙ্গু জ্বরের রোগী পাওয়া গেছে। তবে গ্রামে ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদূর্ভাব খুবই কম।
ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ কি?
ডেঙ্গু জীবাণু শরীরে প্রবেশ করলেই যে ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাবে, তা কিন্তু ঠিক নয়। অনেক রোগী, বিশেষ করে ১৫ বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের শরীরেজীবাণু প্রবেশ করলেও অনেকক্ষেত্রে রোগের কোনো লক্ষণ প্রকাশ নাও পেতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাধারণ ভাইরাস জ্বরের মত লক্ষণ প্রকাশ পায়। তবে ক্ল্যাসিকেল ডেঙ্গু জ্বরে তীব্র জ্বর (১০২- ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট), শরীরে প্রচন্ড ব্যথা, মাথাব্যথা ও চোখে ব্যথা হয়। এছাড়া বমি, পেটে ব্যথা, কোমর, পিঠসহ মাংসপেশি ও অস্থিসন্ধিতে তীব্র ব্যথা হয়ে থাকে। জ্বর আসার তিন বা চার দিনের সময় শরীরে র্যাশ দেখা দেয়। কারো কারো ক্ষেত্রে, বিশেষ করে যিনি পূর্বে একবার ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের বিভিন্ন ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে। সাধারণত জ্বর আসার ৩ থেকে ৪ দিন পর এই জটিলতাগুলো শুরু হয়। এসময় শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্তপাত হতে পারে। যেমন- চামড়ার নিচে, নাক থেকে, দাঁত ও মাড়ি থেকে, কফ ও বমির সঙ্গে, পায়খানা বা প্রস্রাবের সাথে। মেয়েদের মাসিকের সময় অধিক রক্তপাত হতে পারে। এছাড়াও ফুসফুস ও পেটে পানি জমে যেতে পারে, রক্তচাপ কমে গিয়ে রোগী শকে চলে যেতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা কী?
অন্যান্য সাধারণ ভাইরাস জ্বরের মতো ডেঙ্গু জ্বরেরও নির্দিষ্ট কোনো ঔষধ নাই। সাধারণত জ্বর আসার ৫-১০ দিনের মধ্যে এ রোগ নিজে নিজেই ভালো হয়ে যায়। এ সময় জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল জাতীয় ঔষধ খেতে হবে এবং কুসুম গরম পানি দিয়ে বারবার শরীর স্পঞ্জ করে দিতে হবে। সেই সাথে প্রচুর পরিমাণ তরল জাতীয় খাবার যেমন- পানি, খাবার স্যালাইন, লেবুর শরবত, ডাবের পানি, ঘরে বানানো ফলের জুস খেতে হবে। তবেজ্বর আসার সাথে সাথে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। কোনো ধরনের জটিলতা দেখা দিলে দেরি না করে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। সাধারণত জ্বর আসার ৩ দিন পর থেকে জটিলতা শুরু হয়। তাই সেই সময় খুবই সতর্ক থাকতে হবে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ডেঙ্গু জ্বর কি প্রতিরোধযোগ্য?
ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধ করা সম্ভব যদি এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করে দেয়া যায়। তাই বাসার আশেপাশে যাতে ৩/৪ দিনের বেশি কোথাও পানি জমে থাকতে না পারে সেদিকে সবাইকে নজর রাখতে হবে। ফুলের টব, ফুলদানি বা বালতিতে পানি জমা থাকলে সেটা ৩-৪ দিন পরপর ফেলে দিয়ে পরিস্কার করে দিতে হবে। ঘরে নিয়মিত মশার স্প্রে বা কয়েল ব্যবহার করতে হবে। এডিস মশা সাধারণত দিনের বেলা কামড় দেয়। তাই দিনেও মশারী টাঙিয়ে ঘুমাতে হবে। দিনের বেলা শরীর যতটুকু সম্ভব ঢেকে রাখতে হবে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে সবসময় মশারীর ভেতরে রাখতে হবে যাতে মশা কামড়াতে না পারে।
সঠিক সময়ে ডেঙ্গু রোগ নির্ণয় করা গেলে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ সঠিকভাবে মেনে চললে ডেঙ্গু রোগের জটিলতা থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। তাই আতঙ্কিত না হয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে। বাড়ির আশেপাশের এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করতে হবে। জ্বর হলে সময়ক্ষেপন না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। একমাত্র জনসচেতনতাই পারে ডেঙ্গু রোগের প্রাদূর্ভাব থেকে আমাদের রক্ষা করতে।
লেখকঃ ডা. অসিত চন্দ্র দাশ
সহযোগী অধ্যাপক, শিশু বিভাগ
জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ, সিলেট।