লন্ডনে রাস্তায় ফেলে বাংলাদেশী যুবককে পুলিশের নির্যাতন, তোলপাড়
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ জুলাই ২০১৯, ১০:৫১ অপরাহ্ণ
লন্ডন অফিস:
এক যুবকের ওপর আগ্রাসী দুই পুলিশ সদস্য। রাস্তায় ফেলে হাতকড়া পড়ানোর জোর চেষ্টা করছেন। ওই যুবক বার বার চিতকার করে তাঁকে গ্রেফতারের কারণ জানতে চাইছেন। আর স্বামীকে ছেড়ে দেয়ার জন্য আকুল অনুরোধ করে চলেছেন স্ত্রী। আশপাশের মানুষও পুলিশকে পেশাদার আচরণ করার অনুরোধ জানাচ্ছেন। কিন্তু কারও কথায় কর্ণপাত করছে না পুলিশ। একজন পুলিশ সদস্যকে দেখা যাচ্ছে হ্যান্ডকাফ দিয়ে ওই যুবকের গায়ে একের পর এক আঘাত করছেন তিনি। যেন ওই যুবকের ওপর ব্যক্তিগত ক্রোধের ঝাল মেটাচ্ছেন তাঁরা। পূর্ব লন্ডনের পপলার এস্টেটে ঘটেছে এমন ঘটনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হয়ে যায়। ভডিওতে পুলিশের আচরণ দেখে ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে টাওয়ার হ্যামলেটসের মানুষ।
গত ৯ জুলাই মঙ্গলবার এই ঘটনা ঘটে। মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে টাওয়ার হ্যামলেটসে পুলিশের জবরদস্তিমূলক আচরণের এটি দ্বিতীয় ঘটনা। আগের ঘটনায় কমার্সিয়াল রোড়ে এক বাঙালি তরুণকে রাস্তায় ফেলে জবরদস্তিমূলক আচরণ করে পুলিশ।
পুলিশের এমন আচরণের প্রতিবাদে গত ১২ জুলাই শুক্রবার টাওয়ার হ্যামলেটসে বড় ধরণের বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিবাদ সভা করেছে বাংলাদেশিদের বিভিন্ন সংগঠন। পুলিশ সদস্যদের এমন আচরণকে অপেশাদার এবং বর্ণবাদী আখ্যায়িত করে দায়ী পুলিশ সদস্যদের বিচারের মুখোমুখি করার আহবান জানানো হয়েছে।
গত ৯ জুলাইয়ের ঘটনায় ভুক্তভোগী ব্যক্তির নাম ইউনিস বেনতাহার (৩৮)। তিনি মরক্কান নাগরিক। ভিডিওটিতে দেখা যায়, দুইজন পুলিশ অফিসার ইউনিস বেনতাহারকে হাতকড়া পরানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু ইউনিস সর্বশক্তি খাটিয়ে পুলিশকে প্রতিহত করার চেষ্টা করছেন। তাই একসময় পুলিশ তাকে মাটিতে ফেলে তার উপরে ওঠে বসে হাতকড়া পরানোর চেষ্টা করে। কিন্ত ইউনিস বেনতাহার তখন দুই পুলিশ অফিসারকে ধাক্কা দিয়ে ওঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। ইতিমধ্যে আরো কজন পুলিশ অফিসার ঘটনাস্থলে এসে হাজির হন এবং তার হাতে হাতকড়া পরানোর চেষ্টা করেন। এভাবে কয়েক মিনিট কেটে যায় পুলিশ ইউনিসের হাতে হাতকড়া পড়াতে পারছিলেন না। একসময় ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে ইউনিস বেনতাহার নিস্তেজ হয়ে পড়েন। তার মুখে রক্তের দাগ দেখা যায়।
জানা গেছে, পুলিশের ধস্তাধস্তির কারণে তিনি আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন। পুলিশ তাকে নিউহ্যাম হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দিয়েছে। এভারফিলড এস্টেটের মার্চেন্ট হাউসের এক বাসিন্দা জানান, ইউনিস বেনতাহার মরক্কান বংশোদ্ভুত। তাঁর স্ত্রী সোমালিয়ান। ঘটনার দিন ৯ জুলাই মঙ্গলবার বিকেলে তারা দুইজন তাদের ৪ বছরের ছেলে ও ২ বছরের মেয়েকে নিয়ে বোনের ফ্লাটে বেড়াতে আসছিলেন। বোনের ঘর মার্চেন্ট হাউসের তৃতীয় তলায়। ২ বছরের মেয়েটি প্রতিবন্ধী। বিকেল সাড়ে ৫টার কিছু আগে তারা এভারফিলড এলাকার অবান স্ট্রিটে সিঙ্গেল ইয়ালো লাইনে গাড়ি পার্ক করেন। ২ বছরের মেয়েটি প্রতিবন্ধী হওয়ায় তাদের গাড়ি পার্কিংয়ের ব্লু ব্লেজ ছিলো। তিনি যখন গাড়ি পার্ক করে নামবেন তখনই পেছনে থাকা দুই একজন পুলিশ অফিসার এগিয়ে আসেন। পুলিশ বলে, সেখানে তিনি অবৈধভাবে গাড়ি পার্ক করছেন। কারণ সামনে হাইওয়ে হওয়ার কারণে এখানে গাড়ি পার্ক করলে অন্যান্য গাড়ি চালকদের অসুবিধা হবে। তাই ইউনিসকে সেখানে গাড়ি পার্ক করতে নিষেধ করে।
পুলিশের একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ইউনিসকে সিঙ্গেল ইয়ালো লাইনে গাড়ি পার্ক করতে নিষেধ করলে তিনি জানান তার কাছে ডিজেবলড ব্যাজ আছে। কিন্তু পুলিশ এরপরও তাকে সেখানে পার্ক করতে নিষেধ করে। পুলিশের দেয়া তথ্য মতে, তারা তাকে ১৭ বার নিষেধ করার পরও তিনি সেখানে গাড়ি পার্ক করেন। ফলে ৫টি ওয়ার্নিং দেওয়ার পর পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে উদ্যত হয়। পুলিশ তাকে আন্ডার এরেস্ট বলে জানায়। তখন পুলিশ হাতকড়া লাগাতে চাইলে ইউনিস চিৎকার শুরু করেন।
ইউনিস তাঁর স্ত্রী ও দুই শিশুর সামনে তাকে হাতকড়া না পরাতে অনুরোধ করেন। কিন্তু পুলিশ তার সেই অনুরোধে তোয়াক্কা না করে হাতকড়া পরানোর চেষ্টা করে। এদিকে ইউনিসও পুলিশকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। এ নিয়ে মিনিট পাঁচেক ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। কিছু পথচারী এগিয়ে এলেও কেউ তেমন কোনো কথা বলেননি। এদিকে ভিডিওটি ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার পর সাধারণ মানুষ পুলিশের এমন আচরনে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তবে ভিডিও ফুটেজটি ইন্ডিপেনডেন্ট অফিস ফর পুলিশ কনডাক্ট তদন্ত করছে।
এদিকে টাওয়ার হ্যামলেটসের নির্বাহী মেয়র জন বিগস এভারফিহ্বি এস্টেটে গ্রেফতারের ভিডিওটি দেখে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এক বিশেষ বিবৃতিতে তিনি বলেছেন সোশাল মিডিয়ায় সব সময় পূর্ন চিত্র পাওয়া না গেলেও এই ভিডিওটি পরিষ্কারভাবে বিরক্তিকর। আর এজন্য সকালেই পুলিশের সাথে কথা বলে ঘটনাটি দ্রুত তদন্তের জন্য ইন্ডিপেনডেন্ট অফিস ফর পুলিশ কনডাক্ট এর কাছে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছি। মেয়র এখনই এ ব্যাপারে চূড়ান্ত উপসংহার না টানার জন্য অনুরোধ করে বলেছেন, প্রত্যেক বাসিন্দারই নিরাপদে চলাচলের অধিকার রয়েছে এবং একই সাথে পুলিশের প্রতি আমাদের আস্থা থাকাটাও জরুরি। স্বাধীন তদন্তই এবিষয়টি নিশ্চিত করতে পারে। ভয়েস ফর জাস্টিসের প্রতিবাদ
টাওয়ার হ্যামলেটসের এক যুবককে পুলিশী নির্যাতনের প্রতিবাদে গত ১১ জুলাই বৃহস্পতিবার এক প্রতিবাদ সভা করেছে ‘ভয়েস ফর জাস্টিস ইউকে’। পূর্ব লন্ডনের একটি কমিউনিটি হলে অনুষ্ঠিত সভায় বক্তারা বলেন, গাড়ি পার্কিং নিয়ে তুচ্ছু ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুলিশ যেভাবে একজন নিরীহ গাড়ি চালককে আক্রমণ করেছে, তা মোটেই ঠিক হয়নি। একজন নিরীহ যুবকের উপর পুলিশ যে শক্তি প্রদর্শণ করেছে, তা ক্ষমতার অপপ্রয়োগ। পুলিশের এমন আচরণ কমিউনিটিকে দারুনভাবে ব্যথিত করেছে।
সভায় বক্তারা পুলিশের এ অমানবিক আচরণের নিরপেক্ষ পাবলিক ইনকোয়ারির দাবি জানান। সভায় ওই ঘটনার বিচার দাবি করে ব্রিটিশ হোম সেক্রেটারির কাছে চিঠি প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
কমিউনিটি প্রবীণ নেতা হাজী কলা মিয়ার সভাপতিত্বে ও সংগঠনের সচিব কে এম আবু তাহের চৌধুরীর পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সভায় বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ টিচার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি আবু হোসেন, রেডকোর্ট মসজিদের সেক্রেটারি মাহবুব হোসেন, মাওলানা রফিক আহমদ রফিক, জিএসসির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারপার্সন মোহাম্মদ ইছবাহ উদ্দিন, সাংবাদিক আফসার উদ্দিন, হাজী আলতাফুর রহমান; আলহাজ্ব নূর বখশ, সাবেক কাউন্সিলাল মাইয়ূম মিয়া, এসপায়ার টাওয়ার হ্যামলেটসের ট্রেজারার জাহেদ চৌধুরী, হাজী ফারুক মিয়া, আমিনুর চৌধুরী, রফিকুল ইসলাম, মাওলানা আব্দুল কাদের সালেহ, সাংবাদিক আলী হোসেন ও সাংবাদিক বদরুজ্জামান বাবুল প্রমুখ।