মোবাইলে অশ্লীল ভিডিও ও ছবি : পুলিশের খাঁচায় সুনামগঞ্জের নারীলোভী ‘ভয়ঙ্কর এহিয়া’
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ জুলাই ২০১৯, ৪:৫৪ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
ফেসবুকে পরিচয়, তারপর প্রেম। মোবাইল ফোনে দিনের পর দিন আলাপচারিতা। পরিচয় রূপ নেয় ঘনিষ্ঠতায়। ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ঘনিষ্ঠ দৃশ্য গোপনে ধারণ করে রাখেন মোবাইলে। সেই দৃশ্যগুলো নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করতে চান প্রেমিকাকে। তার বান্ধবীদের ফোন নাম্বার চান। নইলে ছড়িয়ে দেবেন ‘অন্তরঙ্গ ভালোবাসা’র চিত্রগুলো। ভয় দেখান, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে সবার কাছে পাঠিয়ে দেবেন ভিডিও ক্লিপ। যন্ত্রণাতে অতিষ্ঠ হয়ে প্রেমিকাই অভিযোগ করেন পুলিশে। অভিযোগের সূত্র ধরে একে একে বেরিয়ে আসে আরোও তিন তরুণীর খোঁজ। যারাও শিকার হয়েছেন একই ব্যক্তির ‘ব্ল্যাকমেইলিং’য়ের। তবে বড় সর্বনাশ হওয়ার আগেই পুলিশের জালে আটকা পড়েছেন ‘ভয়ঙ্কর এহিয়া’।
তৌহিদুর রহমান এহিয়া। নগরীর শেখঘাটের ২৫৩/৩ নম্বর বাসার বাসিন্দা মাহমুদুর রহমানের ছেলে। গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার চিছড়াওলি বুড়াইয়া বাজারে। সিলেটের মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করেছেন। সিলেট মহানগর ছাত্রলীগের অনেক মিছিলে প্রথম সারিতেই দেখা যেতো তাকে। নগর ছাত্রলীগের কার্যনির্বাহী পরিষদেও ছিলেন। আসছে কমিটিতে তার থাকার কথা ছিল যুগ্ম-সম্পাদকের তালিকাতে। এমনই ছিল বাস্তবতা। পঁচিশ বছরের টগবগে তরুণ। সুঠাম দেহের অধিকারী; চেহারাও উজ্জ্বল বর্ণের। দেখলে মনে হয় ‘সুবোধ বালক’। কিন্তু না সুবোধের আড়ালেই এহিয়ার মাঝে লুকিয়ে আছে এক নারীলোভি পশুমন। ব্ল্যাকমেইলিংয়ের মাধ্যমে তরুণীদের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়াই ছিল তৌহিদুর রহমান এহিয়ার নেশা। দীর্ঘদিন ধরে তিনি চালিয়ে আসছিলেন অনৈতিক এমন ঘটনা।
শুক্রবার নগরীর সুরমা মার্কেট পয়েন্ট থেকে পুলিশ তাকে আটক করতে সক্ষম হয়েছে। ওইদিনই তার বিরুদ্ধে পর্ণোগ্রাফি আইনে কোতোয়ালি থানায় মামলা (নং-৪৮) দায়ের করা হয়। মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। আজ তাকে আদালতে নেওয়ার কথা রয়েছে।
কোতোয়ালি থানার এএসআই ও শাহজালাল (রহ.) মাজার পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সহকারী অফিসার মো. ইসমাইল হোসেনের হাত ধরে বেরিয়ে আসে তৌহিদুর রহমান এহিয়া সম্পর্কে ভয়ঙ্কর তথ্য। দীর্ঘ অনুসন্ধানের মাধ্যমে শুক্রবার জুমার নামাজের সময় ইসমাইল আটক করতে সক্ষম হন এহিয়াকে। এসময় এহিয়ার সাথে আরোও কয়েকজন সহযোগী একটি সিএনজি অটেরিকশাতে থাকলেও তারা বিপদ বুঝে কেটে পড়ে।
এহিয়াকে যখন কোতোয়ালি থানায় নেওয়া হয় তখন তার সেলফোন তল্লাশি করেন ওসি সেলিম মিঞা। এসময় ধরা পড়ে বিভিন্ন মেয়েদের সাথে নোংরা কথাবার্তা, অশ্লীল ভিডিও ও ছবি প্রেরণের প্রমাণগুলো। অন্তত ১০/১৫ জন মেয়েকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করে ব্ল্যাকমেইলিং করেছেন তরুণ এহিয়া। তার মুঠোফোনে পাওয়া গেছে একাধিক অশ্লীল ভিডিও। বিভিন্ন মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার দৃশ্যগুলো দেখে আঁতকে উঠেছেন পুলিশ কর্মকর্তারাও। আটক এহিয়া বিরুদ্ধে পর্ণোগ্রাফি আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
শাহী ঈদগাহ অনামিকা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণীর (২২) অভিযোগের ভিত্তিতেই পুলিশের ভিত্তিতেই পুলিশের খাঁচায় ধরা পড়েন এহিয়া। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওই তরুণীর সাথে পরিচয় হয়েছিল এহিয়ার। মাত্র ৫/৬ মাসের পরিচয়েই মেয়েটি এহিয়ার পাতানো ফাঁদে পা দেন। ফেসবুক বন্ধুত্ব রূপ নেয় প্রেমে। ফেসবুক বন্ধু হয়ে উঠেন প্রেমিক-প্রেমিকাতে। মেয়েটির বাসাতেও যাওয়া আসা শুরু করে এহিয়া। বিয়ের আশ্বাসে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়ান ওই তরুণী। মধ্যে সম্পর্ক হয়। পরে এহিয়া বিয়ের আশ্বাস থেকে সরে আসে। একারণে ওই মেয়েটি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে নিজেকে নিজের ঘরেই সীমাবদ্ধ করে নেন। এভাবেই দিন কাটছিল তার। তিনি কারোর সাথে এসব বিষয় শেয়ারও করেননি। এরপরে এহিয়া তার নিজের ফোন নাম্বার (০১৭১৫১৩৭২৪৫) থেকে ওই তরুণীকে ফোন করে জানায়- দু’জনের অন্তরঙ্গ ভিডিও দৃশ্য সে গোপনে ধারণ করেছে। বিশ্বাস হয় না ওই তরুণীর। ১৭ জুলাই আবার দেখা করেন এহিয়ার সাথে, সুরমা মার্কেটে- পাপড়িকা রেস্টুরেন্টে। নিজের চোখে দেখেন এহিয়ার ‘কীর্তি’। ভিডিওগুলো মুছে দেওয়ার অনুরোধ করেন। রাজি হন না এহিয়া, ভয় দেখান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার। কাকুতি মিনতি করেন ওই তরুণী। শর্ত জুড়ে দেন এহিয়া, তার বান্ধবীদের সাথে সম্পর্ক করিয়ে দিলে তবেই মুক্তি মিলতে পারে। আর লুকিয়ে রাখতে পারেন না তরুণী। লজ্জা ভুলে এবার পরিবারের কাছে খুলে বলেন ঘটনা। পরিবারের পরামর্শেই থানায় মামলা করেন তরুণী।
এই একটি গল্পে শেষ নয় তৌহিদুর রহমান এহিয়ার ‘কীর্তিগাথা’। পুলিশের তার নামে একই ধরনের অভিযোগ আরো আছে। ২৯ জুন এহিয়ার ব্যবহৃত মোবাইল নাম্বার দিয়ে সাধারণ ডায়রি করেছিলেন মদিনা মার্কেট এলাকার ২৮ বছরের এক তরুণী। ডায়রিতে তরুণী অভিযোগ করেন একটি মোবাইল নাম্বার (০১৩০৩-৫৫৫৯১৯) থেকে তার নাম্বারে ফোন আসে। জানানো হয় তার কাছে ওই তরুণীর কিছু ব্যক্তিগত ভিডিও আছে। হুমকি দেওয়া হয়, তার সাথে ওই তরুণী যদি দেখা না করে তাহলে অনেক ক্ষতি করবে সে। আতঙ্কিত তরুণী শরণাপন্ন হন পুলিশের। কোতোয়ালি থানায় বিষয়টি অবহিত করেন।
পুলিশের এএসআই ইসমাইল হোসেন যখন প্রথম তরুণীর অভিযোগটি খতিয়ে দেখছিলেন, তখনই তার কাছে আসে দ্বিতীয় তরুণীর অভিযোগটিও। মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে জানতে পারেন দুই ফোন নাম্বারে মালিক একই ব্যক্তি, তৌহিদুর রহমান এহিয়া। জানতে পারেন একই মোবাইল ফোন সেটে ব্যবহৃত হচ্ছে নাম্বার দুটি। এর মধ্যে একটি নাম্বার নিয়মিত ব্যবহার করেন এহিয়া। ঘটনাচক্রে মোগলাবাজারের আরেক তরুণীর খবরও আসে তদন্ত কর্মকর্তার হাতে। নেপথ্যের ‘নায়ক’ ওই একজনই- এহিয়া।
বিষয়টি আঁচ করতে পেরে পুলিশ অফিসার ইসমাইল কৌশলি ভূমিকা গ্রহণ করেন। মোগলাবাজারের তরুণীর সাথে যোগাযোগ করে তিনি এহিয়াকে আটকের ফাঁদ পাতেন। মোগলাবাজারের বাসিন্দা ওই তরুণীকে এহিয়ার সাথে যোগাযোগ বাড়িয়ে দিতে বলেন। একটা পর্যায়ে এহিয়া নিজে থেকেই দেখা করতে চায় ওই তরুণীর সাথে। আবারও একই লোকেশন। সুরমা মার্কেট পয়েন্ট। শুক্রবার জুমার নামাজের সময় ওই তরুণী সুরমা মার্কেটে আসতে বলেন এহিয়াকে। সেখানে আগে থেকেই সাধারণ পোশাকে অবস্থান নিয়েছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা ইসমাইলের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল। এহিয়া সুরমা মার্কেটে এসে ফোন দেন। তরুণী জানতে চান সুরমা মার্কেটের কোন পাশে এহিয়া আছেন। জেনে নিয়ে বিষয়টি মেসেজ করেন ইসমাইল হোসেনকে। তাৎক্ষণিক এহিয়াকে আটক করা হয়। তখন এহিয়ার সাথে থাকা আরোও কয়েকজন সহযোগী পালিয়ে যান।
এহিয়াকে থানায নিয়ে আসার পর কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সেলিম মিঞা তোহিদুর রহমান এহিয়ার সাথে থাকা মোবাইল ফোনে তল্লাশি চালান। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অনুসন্ধান করেন তারা। তখনই নিশ্চিত হওয়া যায় এহিয়ার অন্যরূপ।
এএসআই ইসমাইল হোসেন একাত্তরের কথা’কে জানিয়েছেন, তারা প্রতারক এহিয়াকে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছেন যাতে ভবিষ্যতে এভাবে আর কোনো তরুণী তার প্রতারণার শিকার না হন। এ পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, তোহিদুর রহমান এহিয়াকে দেখলে বুঝতেই পারবেন না যে সে কতো বিশ্রী মনের মানুষ। পোশাক আশাকে অত্যন্ত ভদ্র মনে হলেও সে প্রতারণার ফাঁদ পেতে তরুণীদের সাথে অনৈতিক সম্পর্কে লিপ্ত হতো। আমরা তার মোবাইল ফোন চেক করে অন্তত ২০/২৫ জন তরুণীকে চিহ্নিত করতে পেরেছি। যাদেরকে এহিয়া বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে উত্ত্যক্ত করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তার ইনবক্সগুলো এতোটাই কুৎসিত কথায় পরিপূর্ণ যে ওগুলো স্বাভাবিকভাবে বলা যায় না। সে মেয়েদেরকে অশ্লীল ভিডিও পাঠাতো।
ওসি সেলিম মিঞা বলেন, কোতোয়ালি থানা পুলিশ অত্যন্ত গুরুত্ব ও সতর্কতার সাথে অভিযোগগুলোর তদন্ত করেছে। তদন্তের একপর্যায়ে পুলিশের দক্ষতায় আমরা প্রতারক এহিয়াকে আটক করতে সক্ষম হয়েছি। এরপরই তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলাতে এহিয়াকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। আজ তাকে আদালতে নেওয়া হবে। পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড চাইবে বলেও জানান তিনি। ওসি জানান প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এহিয়া নিজের অপরাধ স্বীকার করেছে।
সুত্রঃ একাত্তরের কথা