সিলেটে মাসুদের রাখা অস্ত্রে কাইয়ুম গ্রেপ্তার, কালিঘাটে তোলপাড়
প্রকাশিত হয়েছে : ১১ জুলাই ২০১৯, ১২:১৮ পূর্বাহ্ণ
ওয়েছ খছরু:
কালীঘাটের ব্যবসায়ী মাসুদ আহমদ নিজেও ফাঁসলেন। ফাঁসালেন দরিদ্র পান দোকানি কাইয়ুমকেও। বস্তায় ভরে একটি নয়, একাধিক আগ্নেয়াস্ত্র রেখেছিলেন পান দোকানে। র্যাবের হাতে অস্ত্রসহ পান দোকানি কাইয়ুম গ্রেপ্তার হয়েছেন। র্যাব তথ্য পেয়ে মাসুদের সন্ধানেও অভিযানে নামে। পালিয়ে বেড়াচ্ছে মাসুদ। আর বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর সিলেটের কাস্টঘর ও মহাজনপট্টির ব্যবসায়ীদের মধ্যে তোলপাড় চলছে। ব্যবসায়ী পিতার সন্তান মাসুদ কেন আগ্নেয়াস্ত্র রাখলেন, কী বা কাজ তার আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে- এ নিয়েও চলছে নানা জল্পনা।
তবে পুলিশ বলছে- এখন তাদের টার্গেট মাসুদ। তাকে গ্রেপ্তার করলেই সব রহস্যের কিনারা হবে। সিলেটের পাইকারি বাণিজ্যিক কেন্দ্র কালীঘাটের শাহচট রুটের ইলিয়াস ম্যানশনের সামনের পান দোকানি আব্দুল কাইয়ুম। স্থানীয় ব্যবসায়ী আব্দুল মছব্বিরের সঙ্গে আব্দুল কাইয়ুমের পিতা আব্দুল মনাফের সুসম্পর্ক ছিল। এ কারণে দয়া করে ব্যবসায়ী আব্দুল মছব্বির আব্দুল মনাফকে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের এক কোনায় পানের দোকান দিয়ে বসিয়ে দেন। প্রায় ৪৫ বছর ধরে এই পানের দোকান দিয়েই পরিবার চলছে মনাফের। এর মধ্যে মনাফ মারা গেলে তার ছেলে আব্দুল কাইয়ুম পানের দোকানের হাল ধরেন। স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও কাইয়ুমকে দেখে শুনে রাখেন। আব্দুল কাইয়ুমের বাড়ি নগরীর কাজীটুলার ১৭-বি আবাসিক এলাকায়। ঘরে তার মা, স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছে। পরিবারের লোকজন জানান- কালিঘাট বাণিজ্যিক কেন্দ্র হওয়ার কারণে খুব সকালেই বাজার জমে যায়। এ কারণে ফজরের নামাজের পরপরই কাইয়ুম দোকানে চলে যান। তিনি গিয়ে দোকান খুলে বসেছিলেন। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে র্যাব সদস্যরা তার দোকানে অভিযান চালায়। এ সময় দোকানের ভেতর থেকে বস্তায় অস্ত্র পায়। র্যাব ওই অস্ত্রসহ আব্দুল কাইয়ুমকে ধরে নিয়ে আসে। ফেরার পথে র্যাব সদস্যরা আব্দুল কাইয়ুমকে নিয়ে নগরীর ছড়ার পাড়ের ব্যবসায়ী মাসুদ আহমদের বাড়িতে তল্লাশি চালায়। র্যাব খোঁজ করছিল মাসুদকে। কিন্তু র্যাবের অভিযানের আগেই মাসুদ আহমদ পালিয়ে যায়। মঙ্গলবার র্যাব-৯ থেকে গণমাধ্যমে প্রেরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে অস্ত্র উদ্ধার অভিযানের তথ্য জানায়।
র্যাব জানায়- গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তারা অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে নামে। এ সময় তারা কালীঘাট শাহচট রোডস্থ মেসার্স ছত্তার ট্রেডার্সের সামন থেকে ১টি বিদেশি রিভলবার, দুই রাউন্ড গুলি, একটি শর্টগান ও কার্তুজ সহ আব্দুল কাইয়ুমকে গ্রেপ্তার করেছে। পরে র্যাব বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেছে। পুলিশ জানায়- এ মামলায় র্যাব প্রধান আসামি করেছে পান দোকানি আব্দুল কাইয়ুমকে। তবে- এ মামলায় কালীঘাটের ব্যবসায়ী ছত্তার ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী ছত্তার মিয়ার ছেলে মাসুদ আহমদকেও আসামি করেছে। এজাহারে র্যাব সদস্যরা উল্লেখ করেছেন- কাইয়ুমের মুখের ভাষ্য মতে, এই অস্ত্র রেখেছে মাসুদ। মাসুদের সঙ্গে কাইয়ুমের সম্পৃক্ততা রয়েছে। এদিকে- কাইয়ুমকে গ্রেপ্তারের পরপরই র্যাব সদস্যরা তাকে নিয়ে ছড়ার পাড়ের সুগন্ধা আবাসিক এলাকার ছত্তার মিয়ার বাসায় যায়। সেখানে র্যাব মাসুদের খোঁজে তল্লাশি চালায়। কিন্তু পায়নি।
অভিযানের আগেই মাসুদ পালিয়ে যায়। এদিকে- দুটি আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি উদ্ধারের ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত আব্দুল কাইয়ুমকে মঙ্গলবার রাতে কোতোয়ালি থানায় প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে কাইয়ুম পুলিশকে জানিয়েছে- দুই দিন আগে পাশের দোকানের মাসুদ আহমদ ওই ব্যাগটি তার দোকানে রেখে যায়। ব্যাগে কী আছে তিনি নিজেও খুলে দেখেননি। র্যাব সদস্যরা যাওয়ার পর তিনি দেখেন ব্যাগে অস্ত্র। এর আগেও মাসুদ আহমদ একাধিকবার এভাবে ব্যাগ রেখেছিল। পাশের দোকানের দীর্ঘ দিনের পরিচিত ব্যবসায়ী হওয়ার কারণে তিনি ব্যাগ খুলে দেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। ব্যাগ রেখে আবার মাসুদ নিয়ে যেতেন বলে পুলিশকে জানান তিনি।
সিলেটের সুবহানীঘাট ফাঁড়ির ইনচার্জ ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই অনুপ কুমার চৌধুরী জানিয়েছে- র্যাব যেহেতু অস্ত্রসহ কাইয়ুমকে ধরেছে একারণে তাকেই প্রধান আসামি করেছে। অস্ত্র রিকভারী ব্যক্তিই হচ্ছেন মূল অভিযুক্ত। এরপর মামলায় মাসুদ আহমদকে আসামি করেছে। মাসুদ পলাতক রয়েছে। তাকে গ্রেপ্তারেও আমরা সোর্স নিয়োগ করেছি। মাসুদ গ্রেপ্তার হলে কোথায় থেকে, কী কারণে অস্ত্র আনা হয়েছে সে বিষয়ের রহস্য খোলাসা হবে। কাইয়ুমকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে বলে জানান অনুপ। ঘটনার পর থেকে সক্রিয় রয়েছেন মাসুদের পিতা কালীঘাটের ব্যবসায়ী ছত্তার মিয়া। মঙ্গলবার তিনি কাইয়ুমের খোঁজে র্যাব কার্যালয় পর্যন্ত গিয়েছিলেন। গতকালও ছিলেন আদালতে। তিনি কাইয়ুমের পরিবারকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।
কালীঘাটের ব্যবসায়ীরা গতকাল জানিয়েছেন- কাইয়ুম কখনোই অপরাধে জড়িত নয়। মাসুদই দোকানে অস্ত্র রেখে কাইয়ুমকে ফাঁসিয়েছে। তারা জানান- মাসুদ আহমদ বিরোধী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এলাকায় প্রভাব খাটানোই তার কাজ। রয়েছে কিছু বখাটে ও ক্যাডার বন্ধুও। তাদের বাড়িও ছড়ারপাড়, কামালগড় ও কালীঘাট এলাকায়। এসব এলাকার প্রভাব ধরে রাখতে তারা প্রায় সময় ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে। এ কারণে মাসুদের সঙ্গে তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কারো কারো দূরত্ব রয়েছে। এ ছাড়া- মাসুদ প্রায়ই এসে ছত্তার মিয়ার চালের আড়তের ক্যাশে এসে বসতো। এখান থেকেই কাইয়ুমের সঙ্গে অন্যদের মতো তারও সম্পর্ক ছিল।
গ্রেপ্তার হওয়া কাইয়ুমের স্ত্রী হাজেরা বেগম গতকাল জানিয়েছেন- র্যাবের বিরুদ্ধে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই। র্যাব আইন অনুযায়ী কাজ করেছে। আমাদের সব ক্ষোভ মাসুদের ওপর। কারণ- মাসুদই সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তার স্বামীকে ফাঁসিয়েছে। তিনি বলেন- তার স্বামী পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। তিনি কারাগারে থাকায় তাদের পরিবার অভুক্ত অবস্থায় রয়েছে। কালীঘাটের শাহচট রুটের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন- বিষয়টি নিয়ে এ ঘটনার পর থেকে তারাও শঙ্কিত। এজন্য তারা অপরাধীদের খুঁজে বের করে তাদের গ্রেপ্তারের দাবি জানান।
মানবজমিন