সুরমা-কুশিয়ারার সর্বগ্রাসী ভাঙন : গোলাপগঞ্জে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন নদী পাড়ের মানুষ
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ জুলাই ২০১৯, ৬:৪৮ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ :
গোলাপগঞ্জ উপজেলায় সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর অব্যাহত ভাঙ্গনে নদী গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট ও ফসলী জমিসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল। সর্বগ্রাসী ভাঙ্গন থেকে রক্ষা পাচ্ছে না স্কুল-কলেজ, মাদরাসা, কবরস্থান। বাড়িঘর হারিয়ে নিঃস্ব মানুষ আশ্রয় নিচ্ছেন আশপাশের বাড়িতে অথবা কোন ঝুপড়ি ঘরে। শেষ অবলম্বন নিজের একমাত্র বসতঘর হারিয়ে অনেকে আকুল হয়ে পড়েছেন। এদিকে, অব্যাহত ভাঙ্গনে আতংকে দিন কাটাচ্ছেন নদী পারের মানুষ। এখনো পর্যন্ত পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট কোন বিভাগের দেখা পাননি বলে জানান ভুক্তভোগীরা।
জানা যায়, গোলাপগঞ্জ উপজেলার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে দেশের প্রধান দুই নদী সুরমা ও কুশিয়ারা। উত্তরদিকে গোলাপগঞ্জ পৌরসভা, গোলাপগঞ্জ সদর ইউনিয়ন, বাঘা ও ফুলবাড়ি ইউনিয়নের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে সুরমা নদী। অপরদিকে, উপজেলার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বুধবারিবাজার, বাদেপাশা, শরিফগঞ্জ, ঢাকাদক্ষিণ, আমুড়া ও ভাদেশ্বর ইউনিয়নের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে কুশিয়ারা নদী। বড় দুই নদী উপজেলার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় বিপুল সংখ্যক মানুষ ভাঙ্গনের শিকার হচ্ছেন। হুমকির মুখে রয়েছে এমসি একাডেমিসহ উপজেলার ঐতিহ্যবাহী ৬টি বৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাঘা ইউনিয়নের পূর্বগাঁও, লালনগর, কান্দিগাঁও, রস্তমপুর, মজিদপুর, তুড়কভাগসহ বিভিন্ন স্থানে সুরমা নদীতে ভাঙ্গন অব্যাহত রয়েছে। অব্যাহত ভাঙ্গনের হুমকির মুখে রয়েছে ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী বাঘা মাদরাসা। ইতিমধ্যে মাদরাসার সীমানা প্রাচীরসহ সামনের অনেকাংশ নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। যোগোযোগের গুরুত্বপূর্ণ কান্দিাগাঁও খেয়াঘাটটির একপাশের মাটি সম্প্রতি ধসে গেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। অপরদিকে, সুরমার দক্ষিণ পাড়ে ঐতিহ্যবাহী সরকারি এমসি একাডেমি স্কুল ও কলেজ, রানাপিং আদর্শ স্কুল এন্ড কলেজ, চকরিয়া সুরমা ডাইক(গাঙপারি রোড) ভাঙ্গনের মুখে রয়েছে। এমসি একাডেমি নদী ভাঙ্গন থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে রয়েছে। রানাপিং আদর্শ স্কুল এন্ড কলেজে বালির বস্তা দিয়ে ভাঙ্গন রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রচীরের নিচের মাটি ধসে গেছে। যেকোন সময় সীমানা প্রাচীরসহ ধসে পড়ার শঙ্কার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে, চকরিয়া বাজার সংলগ্ন সুরমা ডাইকের বিভিন্ন অংশ নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
অপরদিকে, সর্বগ্রাসী কুশিয়ারা নদীর অব্যাহত ভাঙ্গনে হারিয়ে যাচ্ছে উপজেলার আরো ৫টি ইউনিয়নের বাড়িঘর, হাটবাজার, সড়ক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ ফসলী জমি। বুধবারী বাজার ইউনিয়নের কালিজুরি, চন্দরপুর বাজার থেকে লামাচন্দরপুর, বনগাও থেকে বুধবারিবাজার ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত চরম ভাঙ্গনের মধ্যে রয়েছে। হুমকির মুখে রয়েছে এলাকার অন্যতম শিক্ষা প্রতষ্ঠিান বাঘিরঘাট উচ্চ বিদ্যালয়। লামাচন্দরপুর এলাকার বিশাল অংশ নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বসতভিটা হারিয়ে মানুষ অন্যের বাড়িতে, হাওরে অথবা খুপড়িঘরে আশ্রয় নিয়েছেন। কুশিয়ারার করাল গ্রাসে নিঃস্ব লামাচন্দরপুর গ্রামের হাওয়ারুন নেছা আবেগজড়িত কন্ঠে বলেন, বাড়িঘর সব শেষ। আর কোন জমিও নেই যে অন্যত্র চলে যাব। স্বামী সন্তান নিয়ে সামান্য একচিলতে জায়গায় চরম দুঃখ-কষ্টে আছি। নদীর দিকে অঙ্গুল তুলে দিনমজুর ইমাম হোসেন বলেন, ঐ যে পনির ¯্রােত দেখছেন ঐখানেই ছিল আমার বাড়ি। এখন অন্যের জায়গায় একটি টিনের চালা তৈরি করে পরিবার নিয়ে থাকি।
এদিকে, বাদেপাশা ইউনিয়নের হাজিরকোনা গ্রাম থেকে ডেপুটিবাজার-মফজ্জিল আলী দ্বিপাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয়, বাগলাছঘরি হতে বাগলা বাজার এবং আছিরগঞ্জ খাল থেকে আমকোনা মাজার এই ৩টি পয়েন্ট ভয়াবহ ভাঙ্গনের মধ্যে রয়েছে। ইতিমধ্যে অনেক বাড়ি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এলাকার হুমকির মুখে রয়েছে মফজ্জিল আলী দ্বিপাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয় ও গুরুত্বপূর্ণ বাগলা বাজার। ভাঙ্গনে এলাকার গুরুত্বপূর্ণ বসন্তপুর-কটলিপাড়া সড়কের বাঘলাবাজার সংলগ্ন অংশে ফাটল দেখা দিয়েছে। যেকোন সময় সড়কটির এই অংশ ধসে পড়ার আশংকার কথা জানান এলাকাবাসী।
অন্যদিকে, শরিফগঞ্জ ইউনিয়নের পনাইরচক, মেহেরপুর, পশ্চিম খাটখাই বাজারের উজান অংশ ভাঙ্গন চরম আকার ধারণ করেছে। সদাই শাহ(রহ.)এর মাজারের দুইদিকের মাটি সরে গিয়ে মাজারটি শূণ্যে ঝুলে রয়েছে। হঠাৎ দেখলে মনে ভয় ধরে যায় বলে জানান অনেকে। হুমকির মুখে রয়েছে এলাকার ঐতিহ্যবাহী পনাইরচক উচ্চ বিদ্যালয়। গুরুত্বপূর্ণ বসন্তপুর-কোটলিপাড়া সড়কেরও বিভিন্ন অংশে ভাঙ্গনের আশংকা রয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা। অপরদিকে, নদীর ভাঙ্গনে বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব রজব আলী, রেকিব আলী, তৈয়ব আলী, কুটন আলী, সারো উদ্দিন, নুর উদ্দিনসহ আরো অনেকেই এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সড়কের পাশে টিনের চালা তৈরি করে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করছেন তারা।
এদিকে, ভাদেশ্বর ইউনিয়নের শেখপুর জামে মসজিদ থেকে শাহ চম্পা(রহ.) এর মাজার পর্যন্ত ভয়াবহ ভাঙ্গন রয়েছে। ভাঙ্গনের মুখে রয়েছে ইউনিয়নের গোয়াসপুর এলাকা। স্থানীয় সমাজসেবক ও উপজেলা জাতীয় পার্টির সাংগঠনকি সম্পাদক নুরুল আম্বিয়া জানান, ইতিমধ্যে অনেক বাড়ি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী কয়েক বার নৌকায় এই এলাকা পরিদর্শন করেছেন কিন্তু এখনো কোন কাজ হয়নি। এছাড়া, কুশিয়ারার ভঙ্গনের মধ্যে রয়েছে ঢাকাদক্ষিণ ইউনিয়নের সুনামপুর ও ইসলামপুর গ্রাম। চলাচলের রাস্তা নদী গর্ভে ভেঙ্গে পড়ায় ইসলামপুর গ্রাম এখন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। গ্রামের আকবর আলীর বাড়ি ও আখতার আলীর বাড়ির সামনের ভাঙ্গন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ইতিমধ্যে অনেক বাড়ি নদীতে হারিয়ে গেছে। অনেকে অন্যত্র বাড়ি করে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানান স্থানীয়রা। সুনামপুর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা ইরফান আলী দিশেহারা অবস্থা দেখেই বুঝা যায় কি মহাদুর্যোগের মধ্যে রয়েছেন তাঁরা। কাছে এসে আকুল কন্ঠে বলেন, তার বাড়িসহ প্রায় ২ কেদার জায়গা নদী গ্রাস করে নিয়েছে। পরে একটু উপরে আবারো বাড়ি করেছেন। কিন্তু এবারের ভাঙ্গনে তার নতুন বাড়িও গ্রাস করে নেয়ার অবস্থা। গাছপালাসহ বাড়ির সামনের অংশ কিছুদিন আগে নদীর মধ্যে চলে গেছে। সুনামপুর গ্রামের সাবেক মেম্বার ও ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ফখরুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন থেকেই ভাঙ্গন চলছে। কিন্তু কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। এভাবে চললে একসময় গ্রামের মানচিত্রই বদলে যাবে। নদী ভাঙ্গন রোধের দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার আবেদন জানিয়ে শরিফগঞ্জ ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি বিশিষ্ট সমাজসেবক লুৎফুর রহমান বলেন, নদী ভাঙ্গনে নি¤œ আয়ের মানুষেরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। যিনি কিছুদিন আগেও ছিলেন স্বাবলম্বী তিনিই সর্বস্ব হারিয়ে হয়ে যাচ্ছেন সাহায্য প্রার্থী। নদীর এ সর্বগ্রাসী ভাঙ্গন থেকে এলাকাবাসীকে রক্ষায় তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্টদের দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান।
এব্যাপারে বাদেপাশা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মস্তাক আহমদ বলেন, নদী ভাঙ্গনে বাদেপাশা ইউনিয়নের বিপুল সংখ্যক মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন এবং হচ্ছেন। পূর্বপুরুষের বাড়িঘর হারিয়ে অনেকেই অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি ও দুর্ভোগ বর্ননা করার মতো নয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় স্বাধীনতার পর থেকে এখনো পর্যন্ত নদী ভাঙ্গন রোধে এই ইউনিয়নে কোন কাজ হয়নি। জনস্বার্থে অতিদ্রুত নদী ভাঙ্গন রোধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান তিনি।
নদীর তীর সংরক্ষণ ও নদী ভাঙ্গন রোধে ইতিমধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে যোগাযোগ করছেন জানিয়ে গোলাপগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি এডভোকেট ইকবাল আহমদ চৌধুরী বলেন, এ বিষয়টি নিয়ে তিনি অনেক আগে থেকেই কাজ করছেন। ইতিমধ্যে তিনি নিজে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করেছেন এবং জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় বিষয়টি উত্থাপন করেছেন। তিনি জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রকল্প তৈরি করে প্রেরণ করলে প্রকল্প বাস্তবায়নে তিনি তাদের সাথে কাজ করবেন বলে তাদের জানিয়েছেন। তিনি বলেন, নদী ভাঙ্গন একটি দীর্ঘমেয়াদী বিষয়। আগে থেকে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে চরম আকার ধারণ করেছে। আশ্রায়ন প্রকল্পের মাধ্যমে গৃহহীনদের সহায়তার বিষয়টি তার বিবেচনায় রয়েছে বলে জানান তিনি।
এব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী শহিদুজ্জামান জানান, ভাঙ্গনের শিকার বিভিন্ন এলাকার নাম উল্লেখ করে কারিগরি কমিটি গঠনের প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়েছে। সেই কমিটি পিপিপি দাখিল করলে তার ভিত্তিতে প্রকল্প অনুমোদন হলে কাজ শুরু হবে। এই প্রস্তাবের মধ্যে গোলাপগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা রয়েছে।