নবীগঞ্জে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি : সবাই কৃষক, মৃতরাও আছেন তালিকায়
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ জুন ২০১৯, ৯:৫৫ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ :
হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলায় সরকার কর্তৃক সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান ও চাল ক্রয়ে চলছে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি। কৃষি পেশায় নেই এমন ব্যক্তিদের নাম তুলা হয়েছে কৃষক তালিকায়। এমনকি জনপ্রতিনিধিরা তালিকায় তাদের আত্বীয়-স্বজনের পাশাপাশি নিজেদের নামও রেখেছেন। তালিকায় রয়েছে রাজনৈতিক নেতা, প্রবাসী এমনকি মৃত ব্যক্তিরও নাম। কোনো কোনো তালিকায় একই পরিবারের ৫ থেকে ৭ জনকে কৃষক হিসাবে দেখানো হলেও একাধিক ইউনিয়নের তালিকায় অনেক গ্রামকেই বাদ দেওয়া হয়েছে।
এ বছর বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। তবে ধানের মূল্য কম হওয়ায় কৃষকরা হতাশা হয়ে পড়েন। ধানের মূল্য বৃদ্ধির দাবি ওঠে সর্বত্র। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে।
ধান সংগ্রহ কার্যক্রম শুরুর পূর্বে উপজেলার একটি পৌরসভাসহ ১৩টি ইউনিয়নে কৃষকদের নামের তালিকায় তৈরি করা হয়। তবে তালিকা তৈরিতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। তালিকায় রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের জনপ্রতিনিধি ও অনেক নেতা-কর্মীর নাম। এমনকি জনপ্রতিনিধিরা তালিকায় তাদের আত্বীয়-স্বজনের নামও রেখেছেন। তালিকায় রয়েছে রাজনৈতিক নেতা, প্রবাসী এমনকি মৃত ব্যক্তিরও নাম।
উপজেলার ২নং বড় ভাকৈর ইউনিয়নের তালিকায় রয়েছে উপজেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ইউপি সদস্য আনোয়ার মিয়া, ইউপি চেয়ারম্যান আশিক মিয়ার ভাতিজা আবুল কাশেম তারেক, আবু বক্কর ও ইউপি সদস্য এহিয়া মিয়ার নাম। রয়েছে লন্ডন প্রবাসী সুজন আমীনের নামও। দীঘলবাক ইউনিয়নের তালিকায় রয়েছে চেয়ারম্যান আবু সাঈদ এওলা মিয়ার নাম। এছাড়াও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম হোসেন ও তার ছেলে ইমরান হোসেনের নামও রয়েছে। গজনাইপুর ইউনিয়নের তালিকায় মোট নাম রয়েছে ৬৬ জনের। এ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ইমদাদুর রহমান মুকুলের নিজ গ্রাম সাতাইহাল ও নিকটবর্তী কুর্শা গ্রামের তালিকায় রয়েছে ৬০ জনের নাম। তালিকার ৩ নাম্বারে রয়েছে চেয়ারম্যান মুকুলের বড় ভাই হাজী মো. বজলুর রহমানের নাম। এছাড়াও তালিকায় রয়েছে ওই আওয়ামী লীগ নেতার নিজ গোষ্ঠির প্রায় ৩০ জনের নাম। উক্ত তালিকায় এক পরিবারের রয়েছে একাধিক সদস্যের নামও। কিন্তু এ ইউনিয়নের তালিকায় মামদপুর, শিয়ালেরপুঞ্জি, শংকরসেনা, নিশাকুড়ি, লোগাও, বনগাও, লামরোহ, গজনাইপুর, টাল্লিয়া, দেওপাড়া, দরগাপাড়া, মুরাউরা, কামারগাঁওসহ অনেক গ্রামের কোনো কৃষকের নামই নেই তালিকায়।
উপজেলার দেবপাড়া ইউনিয়নের তালিকার ১৬ নাম্বারে ইউপি চেয়ারম্যান মাসুম আহমেদ জাবেদের ছেলে শাহ রিয়াজ নাদির সুমন, ১৫ নাম্বারে উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক গুল আহমেদ কাজল, ৯৩ নাম্বারে দেবপাড়া ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি শামীম আহমদের নাম রয়েছে। রয়েছে দেবপাড়া ইউপি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ইউপি সদস্য আব্দুল মুকিতের নাম। এছাড়াও ইউপি সদস্য আজিজ মিয়া, আজাদ মিয়া, বশির মিয়া ও মহিলা ইউপি সদস্য শাহ রাবেয়া বেগম নামও রয়েছে তালিকায়।
পানিউমদা ইউনিয়নের তালিকায় ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ইজাজুর রহমানের নাম রয়েছে। রয়েছে ইউপি সদস্য আরজদ আলীর নামও। আউশকান্দি ইউনিয়নের তালিকার ৪১ নাম্বারে রয়েছে মিনাজপুর গ্রামের মৃত মহিলা রাহিমা বেগমের নাম। তিনি প্রায় ১০/১২ বছর পূর্বে মারা গেছেন। এছাড়াও অন্যান্য ইউনিয়নের তালিকায় ইউপি সদস্য, রাজনৈতিক নেতা ও প্রবাসীদের নাম রয়েছে।
এদিকে, উপজেলার এবার ৫৩৮ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও ইতোমধ্যে সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ১৭০ মেট্রিক টন। কৃষকদের অভিযোগ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ধান ক্রয় করা হচ্ছে। তাই ধান সংগ্রহ হচ্ছে কম। তাছাড়া খাদ্য গোদামের কর্মকর্তাকে তাদের ‘চাহিদা মতো’ টাকা না দিলে নানা অজুহাতে কৃষকদের ধান তারা ফিরিয়ে দেন।
এ ব্যাপারে শিবলু মিয়া নামে এক কৃষক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রভাবশালী একটি মহলের ছত্রচ্ছায়ায় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ধান সংগ্রহ করা হচ্ছে। তিনি এক সপ্তাহ ধরে ধান নিয়ে গেলেও তার ধান নানা অজুহাত দেখিয়ে নেওয়া হয় না।
তালিকাভুক্ত কৃষক কামাল মিয়া জানান, খাদ্য কর্মকর্তার কথা অনুযায়ী এক সাপ্তাহ ধরে আমার ধান খাদ্য গোদামে রাখা হয়েছে। কিন্তু মাপ-ঝুক করা হচ্ছেনা।
কৃষক আনছার মিয়া জানান, কৃষি কর্মকর্তা ও ইউপি সদস্যকে টাকা না দেওয়ায় আমাদের ৩ জনের নাম তালিকায় অর্ন্তভুক্ত করা হয়নি। ফলে আমরা এখন ধান বিক্রি করতে পারছিনা। সরকার কার জন্য ধানের দাম বাড়ালো।
কৃষকদের নামের তালিকা তৈরি, ধান সংগ্রহ এবং গোদামজাত করনে অনিয়ম হওয়ায় কারণে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে কৃষকদের পাশাপাশি সর্বমহলে। কৃষকসহ সচেতন লোকজন মনে করেন জনপ্রতিনিধি, উপজেলা খাদ্য অধিদপ্তর ও কৃষি অফিসের কর্মকর্তাদের গাফিলতিতে হয়েছে এসব অনিয়ম। ফলে সংশ্লিষ্ট অসাধু কর্মকর্তা, কর্মচারি ও জনপ্রতিনিধিরা এখন নিজেদের দায়ভার এড়িয়ে একে অপরের প্রতি দোষ চাপাচ্ছেন।
তালিকার অনিয়মের অভিযোগে ধান সংগ্রহের কার্যক্রম ইতোমধ্যে স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজ মিলাদ। একই সাথে নবীগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি আতাউল গণি ওসমানীকে আহবায়ক করে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করাও হয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে খাদ্য গুদাম ইনচার্জ আহসান হাবিবের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমাদের এখানে কোন দুর্নীতি হচ্ছে না। আমরা কৃষকের তালিকা অনুযায়ী ধান নিচ্ছি। কৃষি অফিসের করা তালিকায় যদি কোন কৃষক বাদ পড়ে আমাদের কিছু করার নেই। আবার কোন অকৃষক যদি তালিকায় ঢুকে যায় তাহলেও আমাদের কিছু করার নেই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা কারো কাছ থেকে টাকা নেইনি। যারা এসব অভিযোগ করেছে সেটা সঠিক নয়।
নবীগঞ্জ উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক গৌরি পদ বলেন, নবীগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসের কর্মকর্তারাই এব্যাপারে ভাল বলতে পারবেন। কারণ তাদের মাধ্যমেই কৃষকদের তালিকা করা হয়েছে। আমরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কৃষক আসলে তাদের ধান সংগ্রহ করি। তবে কোনো কোনো কৃষক ধান রেখে চলে যান।
এব্যাপারে নবীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এ কে এম মাকসুদুল আলম বলেন, আমরা স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বারদের সহযোগিতায় কৃষকদের তালিকা তৈরি করেছি। তালিকায় কোনো অনিময়-দুর্নীতি হয়ে থাকলে আমরা খতিয়ে দেখবো।
এব্যাপারে নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ধান-চাল সংগ্রহ কমিটির সভাপতি তৌহিদ বিন হাসান বলেন, কৃষকের তালিকা তৈরিতে কোন অনিয়ম হয়ে থাকলে তা খতিয়ে দেখা হবে এবং ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং বন্ধ রয়েছে ধান সংগ্রহ কার্যক্রম।
নবীগঞ্জ ধান-চাল সংগ্রহ কমিটির উপদেষ্টা ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল হক চৌধুরী সেলিম বলেন, যদি তালিকায় কোনো জনপ্রতিনিধি ও প্রবাসীর নাম দেওয়া হয় আর পাওয়া যায় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নবীগঞ্জ ধান-চাল সংগ্রহ কমিটির প্রধান উপদেষ্টা হবিগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজ মিলাদ বলেন, অনিয়মের অভিযোগ পেয়ে তাৎক্ষণিক ধান সংগ্রহ কার্যক্রম বন্ধ ও তদন্ত কমিটি গঠনের ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছি।