আজ বালাগঞ্জের গালিমপুর গণহত্যা দিবস
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ মে ২০১৯, ৩:২৪ অপরাহ্ণ
বালাগঞ্জ প্রতিনিধি:
১৯৭১ সালের ১৫মে ধানকাটাকে কেন্দ্র করে পূর্ব পৈলনপুরের ভাটেরা গালিমপুর ও পার্শ্ববর্তী পশ্চিম পৈলনপুর ইউনিয়নের বল্লভপুর গ্রামের কয়েক যুবকের মধ্যে ঝগড়া হয়। এ ঝগড়াকে কেন্দ্র করে লাঠি টানাটানি শুরু হলে এলাকার বিষয়টি এলাকার প্রবীণরা সালিশের মাধ্যমে বিষয়টি দেখে দেওয়ার আশ্বাসে উভয়পক্ষকে শান্ত করেন।
১৭মে সালিশানরা এ ঘটনায় বল্লভপুরের তিন যুবকের মাথা ন্যাড়া করা হয়। এতে ক্ষিপ্ত তিন ন্যাড়া যুবক এ বিষয়ে নালিশ জানায় চকের বাজার শান্তি বাহিনীর ক্যাম্পে এবং আরো জানায় ভাটেরা গালিমপুরের লোকজন মুজিব বাহিনীর সমর্থক। এদের কাছে প্রচুর দেশীয় অস্ত্রও রয়েছে। শান্তি বাহিনীর লোকজন বিষয়টি সাদিপুর ও শেরপুরে অবস্থানরত পাকসেনাদের অবগত করে। ১৮মে সকালে ফাজিলপুরের মদরিছ আলী ভাটেরা-গালিমপুর এসে জানান, ‘দেশ জুড়ে যখন দাঙ্গা শুরু হয়েছে সে মুহূর্তে দুগ্রামের মধ্যে সংঘর্ষ ও পরবর্তী বিচার প্রক্রিয়ায় পাকসেনারা চরম অখুশি। শেরপুর ক্যাম্পে অবস্থানরত পাক ক্যাপ্টেন নিজে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বল্লভপুর ও ভাটেরা-গালিমপুরে আসবেন।’ এ খবরে ভীত হয়ে পড়ে ভাটেরা-গালিমপুরের লোকজন। তারা বিষয়টি সামাল দিতে মদরিছ আলীকে অনুরোধ করেন। বিকেলে মদরিছ আলী জানান, ক্যাপ্টেনকে পাঁচ হাজার টাকা দিতে পারলে বিষয়টির সমাধান হতে যেতে পারে। অভাবগ্রস্থ গ্রামবাসী রাতে এ বিষয়ে বৈঠক করে সাড়ে তিন হাজার টাকা সংগ্রহ করেন। পরদিন ১৯মে মদরিছ আলী ও বাহার মিয়াকে সাথে নিয়ে ভাটেরা গালিমপুরের মনাচান দাস ও রাকেশ চন্দ্র দাস শেরপুর পাকিস্তানি ক্যাম্পে গিয়ে অনেক অনুনয় বিনয় করে সাড়ে তিন হাজার টাকায় বিষয়টির দফারফা করেন এবং গ্রামের সবার জন্য শান্তি কার্ড নিয়ে আসেন।
২০ মে বৃহস্পতিবার সকাল ১১টার দিকে ১টি বড় নৌকা নিয়ে সাদিপুর ক্যাম্পে অবস্থানরত ১২জন পাকসেনা সিনজুরা নদী হয়ে ভাটেরা গালিমপুরে প্রবেশ করে। পাকবাহিনীর নৌকা খোকা দাসের বাড়ি ঘাটে এসে লাগলে ভাটেরা গালিমপুরের তিন শতাধিক হিন্দু পরিবারে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। তখন রাকেশ চন্দ্র দাস (মাস্টার বাড়ি), রাকেশ রঞ্জন দাস, মনাচান দাস, রনেন্দ্র বিজয় দাস, দীগেন্দ্র বিজয় দাস পাকবাহিনীকে শান্তি কার্ড দেখান। পাকবাহিনী এসবের তোয়াক্কা না করে ব্রাশ ফায়ার করলে ঘটনাস্থলেই এ পাঁচজন শহীদ হন। এরপর তারা বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে বাড়ি বাড়ি তাল্লাশি চালায়। এতে এলাকার অনেকে গ্রামের ঝোঁপ-ঝাড়ে লুকিয়ে পড়েন। দুই পাকিস্তানি সেনা এলাকার বলবান পুরুষ বলে স্বীকৃত খোকা দাসের বাড়িতে গেলে তিনি দুহাতে সেনা দুজনের গলা টিপে ধরেন। তার শরীরে এতো শক্তি ছিল যে, গলায় চাঁপ খাওয়া দুপাকিস্তানির জিহ্বা বেরিয়ে এসেছিল। তা দেখে অন্য আরেক পাকসেনা পরপর ৩টি গুলি চালিয়ে খোকা দাসকে হত্যা করে। তারপর পাকবাহিনী কিছুটা নার্ভাস হয়ে এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে। এতে বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে থাকা আরো ২৭জন বাঙালি শহীদ হন। গুলিবিদ্ধ হয়েও বেঁচে যান ৪জন। তারা হচ্ছেন গোকুলানন্দ চক্রবর্তী, নগেন্দ্র কুমার দাস, নিতাই চরণ দাশ, বিনয় ভূষণ চক্রবর্তী।
সেদিনের শহীদরা হচ্ছেন ১। খোকা দাস, ২। দীগেন্দ্র দাস, ৩। রনেন্দ্র বিজয় দাস, ৪। দেবব্রত দাস মটর, ৫। সুরেশ দাস, ৬। রাকেশ রঞ্জন দাস, ৭। জগনেন্দ্র দাস, ৮। গুণমণি দাস, ৯। চিত্ত রঞ্জন দাস, ১০। রমাকান্ত দাস, ১১। যোগেন্দ্র দাস, ১২। সাধন দাস, ১৩। হর কুমার দাস, ১৪। নদীয়া রাম দাস, ১৫। ক্ষিরোদ রঞ্জন দাস, ১৬। রাকেশ চন্দ্র দাস, ১৭। সখী চরণ দাস, ১৮। রবীন্দ্র কুমার দাস, ১৯। যামিনী মোহন দাস, ২০। অমূল্য দাস, ২১। অশ্বিনী চক্রবর্তী, ২২। কটাই পাঠনী, ২৩। তরণী চন্দ্র বৈদ্য, ২৪। নৃপেন্দ্র চক্রবতী, ২৫। নরেশ চন্দ্র সূত্রধর, ২৬। মোজাই পাঠনী, ২৭। অশ্বিনী নাথ, ২৮। সদয় চন্দ্র বৈদ্য, ২৯। চরিত্র দাস, ৩০। মহানন্দ নমশূদ্র, ৩১। শৈলেশ নমশূদ্র, ৩২। রমেন্দ্র নমশূদ্র।
হত্যার পর পাকবাহিনী এলাকার শতাধিক হিন্দু বাড়িতে ব্যাপক লুটপাট শেষে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। পাকবাহিনী গ্রামের পার্শ্ববর্তী দেবস্থলীতে ভৈরব মূর্তি ভাংচুর করে। অসংখ্য নারীর ইজ্জত হরণসহ প্রায় চার ঘণ্টা বিরতিহীন তা-ব শেষে পাকসেনা ও দালালরা এলাকার দুই গৃহবধূকে ধরে নিয়ে যায়। পাকবাহিনী চলে যাবার পর শোকে হতবিহ্বল গ্রামবাসী এক সাথে নিহত প্রথম পাঁচজনকে সেখানেই মাটি চাঁপা দেয়। শহীদ অনেকের লাশ কাপড় জড়িয়ে কুশিয়ারা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয় অনেককের লাশ দেওয়া হয় মাটিচাঁপা। তিনদিন পর পাকবাহিনীর ধরে নিয়ে যাওয়া দুই গৃহবধূ ক্ষত-বিক্ষত দেহে গ্রামে ফিরে আসলে তাদের মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় ভারতের শরণার্থী ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
গালিমপুর হুরুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে শহীদদের গণকবরটি দীর্ঘদিন অরক্ষিত ছিলো। ২০০৯ সালে প্রায় ৩লক্ষ টাকা ব্যয়ে সেখানে একটি শহীদ স্বম্ভ নির্মাণ করা হয়।