সিলেট বেড়েছে বিবাহ বিচ্ছেদ: এগিয়ে নারীরা, ২৫ হাজার তালাক
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ মে ২০১৯, ১:১২ পূর্বাহ্ণ
সুরমা নিউজ :
সিলেট নগরীতে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় গত বছর ও চলতি বছরে আশংকাজনক হারে বিবাহ বিচ্ছেদের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। বিচ্ছেদের আবেদন করার ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছেন নারীরা এমনটি বলছে সিটি কর্পোরেশন। আর বিচ্ছেদ বৃদ্ধির কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, সন্দেহ, যৌতুক দাবি, সঙ্গীর দ্বারা শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার, স্বামী-স্ত্রীর জীবন-যাপনে অমিল, সন্তান-সন্তানাধী না হওয়া, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, দীর্ঘ দিন থেকে স্বামী কিংবা স্ত্রী বিদেশে, পরকিয়া এবং মাদকাসক্তিসহ বিভিন্ন কারণে বর্তমানে বিচ্ছেদের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সিলেট সিটি করপোরেশন তথ্যানুযায়ী, ২০১০-২০১৯ সাল পর্যন্ত নগরীতে তালাকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৪ হাজার ৯১২টি। এর মধ্যে পুরুষের পাঠানো নোটিসের সংখ্যা ৮ হাজার ৯৬টি এবং নারীর ১৬ হাজার ৮১৬টি। অর্থাৎ নারীরা পুরুষের চেয়ে দ্বিগুণ বিচ্ছেদের আবেদন করেছেন। ২০১৬ সালে সিলেট নগরীতে বাসিন্দাদের মোট ৪ হাজার ৮৪৭টি বিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে পুরুষের এক হাজার ৪২১টি আর নারীর তিন হাজার ৪২৬টি।
এক্ষেত্রেও আবেদনকারীদের মধ্যে এগিয়ে নারী। ২০১৬-১৭ সালে মোট ৪৩৮ জন বিচ্ছেদের আবেদন করেন। আর প্রতি মাসে গড়ে সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকায় বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করে ২২ দম্পতি। এ হিসাবে প্রতিদিন সিলেটে এক দম্পতি বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করেন।
২০১৮-১৯ সালে বিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়েছে ৩৩১টি। মহানগরীতেও বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৮ সালে ২৫৫জন আবেদন করে। এরমধ্যে পুরুষ ৮৪ নারী ১৭১জন। আর চলতি বছরের গত চার মাসে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন জমা পেেছ ৭৬টি। এরমধ্যে পুরুষের সংখ্যা ২৯জন নারী ৫৭ জন রয়েছে। আবেদনের ক্ষেত্রে নারীরাই এগিয়ে রয়েছেন।
সিলেট সিটি করপোরেশনের সচিব মোহাম্মদ বদরুল হক বলেন, বিচ্ছেদের আবেদন পাওয়ার পর দুই পক্ষকে প্রতি মাসে শুনানির জন্য ডাকা হলেও ৯০ ভাগ ক্ষেত্রেই এই শুনানির জন্য কোনো পক্ষই সিটি করপোরেশন অফিসে যায় না। তারা আরো বলেন, নারীর পেশাগত উন্নয়ন, আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন এবং সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা আগের চেয়ে বেশি সচেতন। নারীরা লোকলজ্জার ভয়ে এখন আর আপস করছেন না বরং অশান্তি এড়াতে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করছেন।
শুরুতে ভালোলাগা। এরপর প্রেম ভালোবাসা। কিছুদিন প্রেমে মগ্ন হয়ে পালিয়ে বিয়ে। তারপর সুখের সংসার। আবার কেউ পরিবারের সিদ্ধান্তে ঘর বাঁধেন। মধুর এই সংসারে থাকে অসংখ্য স্মৃতি। হাসি, খেলা, আনন্দ, উচ্ছ্বাস সবকিছুর পরেও মাঝে মাঝে শুনতে হচ্ছে ‘বিচ্ছেদ’ নামের শব্দটি। এই ‘বিচ্ছেদ’ নামের বিষ বৃক্ষটি যখন সামনে উপস্থিত হয় তখন সব আবেগ হারিয়ে যায় মুহুর্তের মধ্যে। এভাবেই বদলে যাচ্ছে সমাজ, বদলে যাচ্ছে রীতিনীতি।
পরিবার ভেঙে হচ্ছে টুকরো টুকরো। ভালোবাসার বন্ধন ছিঁড়ে হচ্ছে খান খান। বড় পরিবার বা যৌথ পরিবার এখন সবার কাছেই ঝামেলা। ছোট পরিবার বা সংসার গড়তে এখন উদগ্রীব সবাই। নগর কিংবা গ্রাম সর্বত্র একই অবস্থা। কখনো কখনো মেহেদীর রঙ মোছার আগেই ভেঙে যাচ্ছে অনেকের সংসার। কোনো ক্ষেত্রে স্বামীর পরকীয়া, আবার কোনো ক্ষেত্রে স্ত্রীর পরকিয়ার কারণে তালাক হচ্ছে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় সংসারের বন্ধন দুর্বল হচ্ছে ক্রমেই। ভালো লাগা, ভালোবাসাও যাচ্ছে কমে। ফলে বাড়ছে বিবাহবিচ্ছেদ। মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ে সমাজ আজ থরথর করে কাঁপছে।
সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, একটি পরিবার ভেঙে গেলে শুধু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেই সম্পর্কে ফাটল ধরে না, তাদের সন্তানদের ওপরও এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। বিবাহ বিচ্ছেদ প্রসঙ্গে মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নানা কারণ বর্ণনা করেছেন। তবে যে কথাটি প্রায় সবাই বলছেন তা হচ্ছে ধর্মীয় অনুশাসনের অভাব। বাস্তবেই এটা অনেক বড় কারণ। বিয়ে ভাঙার ক্ষেত্রে ফেসবুক বা মোবাইল কালচার বড় প্রভাব ফেলছে।
বিশেষ করে ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো আমাদের মধ্যে নানা ধরনের আকাঙ্খা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এখান থেকেই বাড়ছে অপ্রাপ্তিবোধ ও হতাশা। তারা আরো বলেন, একটা মানুষ সম্পূর্ণ আলাদা আরেকটা মানুষকে বিয়ে করছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি মানুষের গুণ যেমন আছে তেমনি দোষও থাকবে। দুটো মিলিয়েই মানুষ। সুতরাং পার্টনারের দোষ-গুণ দুটোই মেনে নিতে না পারলে সংসার টেকানো যাবে না।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. প্রাণাশীষ সাহা বলেন, নৈতিক স্খলনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমাজে এখন বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনাও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে প্রবাসী বাঙালি, যাদের স্ত্রী তাদের থেকে দূরে থাকেন। তাদের ঘিরে এই প্রবাসীদের মধ্যে এক ধরনের অবিশ্বাস তৈরি হয়। একই সঙ্গে বাড়ে সন্দেহ প্রবণতা। যা পরবর্তীতে বিচ্ছেদে গিয়ে ঠেকে।
এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, বিচ্ছেদ একটা সামাজিক বিষয়। মুসলিম সমাজের জন্য বিষয়টি খুবই দুঃখজনক ও আশঙ্কাজনক। সামাজিকভাবে নারীদের আত্মমর্যাদা ও কর্মপরিধি বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজেরাই স্বয়ংসম্পূর্ণ। স্বামীর ওপর ভরসা করতে চান না তারা। এ জন্য পারিবারে সমস্যা সমস্যা সৃষ্টি হলে তারা বিচ্ছেদের দিকে যাচ্ছেন। তবে নির্যাতন, আচরণগত সমস্যা এবং সামাজিক অস্থিরতাও বিচ্ছেদের একটি বড় কারণ।