বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল-এর গবেষণাগ্রন্থ বাংলাসাহিত্যে সিলেটিদের গৌরবগাথা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ এপ্রিল ২০১৯, ৫:১২ অপরাহ্ণ
বেলাল আহমদ চৌধুরী:
লেখক বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল অতুলনীয় ও সর্বতোমুখী প্রতিভার অধিকারী। বাংলাসাহিত্যে সিলেটিদের গৌরবগাথা গবেষণাধর্মী গ্রন্থে তার অসামান্য প্রতিভার বিরলদৃষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। লেখক জীবনমুখী সমাজ সচেতন। তিনি একাধারে সাংবাদিকতা এবং প্রকাশনা শিল্পের কারিগর। একজন প্রকাশক হিসেবে তার অসামান্য খ্যাতি ও রয়েছে। বাংলাসাহিত্যে সিলেটিদের গৌরবগাথা একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ও ইতিহাসের মূল্যায়ন। আদিযুগ থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত সিলেটিদের অবদানের কথা উঠে এসেছে এ গ্রন্থে। বাউল, গবেষক, সুফি, দার্শনিক, কবি সাহিত্যিকসহ অনেকের আলোচনায় গ্রন্থটি হয়ে উঠেছে ইতিহাসের সাক্ষী। এর তত্ত্ব ও ইতিহাসসমৃদ্ধ লেখাগুলো শুধু সিলেটের সম্পদ নয় তা এখন সমগ্র বাংলাসাহিত্যের সম্পদ। সিলেটিদের গৌরবগাথা যুগমূল্যায়নের অসাধারণ প্রয়াস।
বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল বাংলাসাহিত্যে সিলেটিদের গৌরবগাথা গ্রন্থখানি সাজিয়েছেন সকলকালের সকল স্থানের তথ্য উপাত্ত নিয়ে। তিনি সাহিত্যের সমুদ্রে সাঁতার কেটেছেন। সাহিত্যের বিচারে তার সাহিত্যের ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত সাহিত্য জগতে মানব হৃদয়ের ঐশ^র্য। তাঁর গ্রন্থখানা প্রাণপ্রাচুর্যের পরিচয় দেয়। তাঁর মননশীল প্রতিভা অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য। সাহিত্য একটি জাতির স্বরূপ অন্বেষার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বর্ণ, গোত্র, ভাষা বা ভূখ-কে কেন্দ্র করে এক একটি জাতির অবয়ব গড়ে উঠে। তাদের শিক্ষা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে এই সব বৈশিষ্ট্য প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। এগুলোকে কেন্দ্র করেই জীবনচক্র আবর্তিত হয়। যারপর তাদের স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা উপলব্ধি করতে বেগ পেতে হয় না।
বাংলাসাহিত্যে সিলেটিদের গৌরবগাথা একটি গবেষণাধর্মী গ্রন্থ। সিলেটের সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে লেখক পুরো বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসের বর্ণনা করেছেন। কারণ সিলেটি নাগরীলিপি ছাড়া অন্যরা তো বাংলাসাহিত্যেরই কাজ করেছেন। চর্যাপদের কবিদের অনেকেই ছিলেন সিলেটি। একই সঙ্গে বৈষ্ণব পদাবলির মূল সত্তা চৈতন্যদেব এবং বিজ্ঞানকাব্যের সাম্প্রতিক ব্যক্তি কবি হাসনাইন সাজ্জাদীও সিলেটের সন্তান। আলোচ্য গ্রন্থটিতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। অধ্যায়গুলো হচ্ছেÑবাংলাসাহিত্যে সিলেট, বাংলাকাব্যের বিবর্তন, মধ্যযুগের বাংলা কাব্য, বৈষ্ণব পদাবলি কাব্য, সিলেটের ফারসি চচার্র মৌলিকত্ব ও লৌকিকত্ব, বাংলাসাহিত্য সাধনায় সিলেটের নারীসমাজ, হাসনাইন সাজ্জাদী : বিজ্ঞান কবিতায় যুগ স্রষ্টা থেকে বিজ্ঞানবাদের দার্শনিক এবং বাংলাসাহিত্যে সিলেটিদের পদছায়া। বাংলাসাহিত্যের জন্ম থেকে শুরু করে বতর্মান যুগের বিজ্ঞান কাব্যচর্চার আন্দোলন পর্যন্ত সিলেটিদের কোথায় এবং কীভাবে ভূমিকা রয়েছে তার সবই জানা যাবে গ্রন্থটি পাঠ করে।
অধ্যাপক সাদাত উল্লাহ খান যেমন তার ভূমিকায় লিখেছেন, সিলেট বাংলাসাহিত্যের উর্বরভূমি। চর্যাপদ থেকে শুরু করে মঙ্গলকাব্যে সিলেটের জয়জয়কার ছিল। বতর্মানে যে, পুঁজিবাদের বিপরীতে বিজ্ঞানবাদ নামে একটি রাজনৈতিক দর্শনের কথা শোনা যাচ্ছে তাও সিলেটের সন্তান বিজ্ঞান কবি হাসনাইন সাজ্জাদীর উপস্থাপিত। একই সঙ্গে বাংলা কাব্যের বাঁক পরিবর্তনে বিজ্ঞান কবিতা একটি আলোচিত বিষয়। কবিতায় উপমা, উৎপ্রেক্ষাও চিত্রকল্পে বিজ্ঞানের প্রয়োগ কবিতার বৈশিষ্ট্য।
লেখকের ভাষ্যমতে, সিলেট, শিলচর ও আসামের পাহাড়ে বসে বৌদ্ধ সহজিয়ারা চর্যাপদ রচনা করেন। সিলেটের মাটি ও মানুষের কথা বাংলা একাডেমির পুরস্কারপ্রাপ্ত গবেষক মুহাম্মদ আসাদ্দর আলী চর্যাপদে সিলেটি ভাষাগ্রন্থে বিস্তারিতভাবে দেখিয়েছেন। সিলেটিদের নিজস্ব বর্ণমালা সিলেটি নাগরী লিপির কথাও উল্লেখ আছে আলোচ্য গ্রন্থটিতে। গুরুত্বসহকারে আলোচিত হয়েছে হাসনাইন সাজ্জাদীর বিজ্ঞানবাদ বিজ্ঞান কাব্যতত্ত্ব ও সাবলীল ছন্দ বিষয়ে। লোকসংস্কৃতি লোকসাহিত্য, ইসলামী দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ এবং মরমী সাধক হাসনরাজার মূল্যায়ন গ্রন্থটিকে অনন্য সাধারণের মর্যাদা দেবে। আমি গ্রন্থটির বহুল প্রচার কামনা করি। বাংলাসাহিত্যে সিলেটিদের গৌরবগাথা। বইটি প্রকাশ করেছে পাণ্ডুলিপি প্রকাশন।
বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল সাহিত্যে সুদূরের অভিযাত্রী। মননে তারুণ্য তার সৃষ্টিশীলতাকে শানিত করেছে। মৌলিক সৃষ্টিকর্মের পাশাপাশি তার সাহিত্য ভাণ্ডারে রয়েছে খাঁটি গদ্যের সমাহার। অগ্রসর চিন্তা ও আদর্শিক চেতনায় এগুলো বিরল ঔজ্জ্বল্যে স্বতন্ত্র। সরলসভ্য জীবন ও বাগ্মী স্নিগ্ধতা তাকে সালংকার চরিত্রবৈশিষ্ট্যে শোভিত করেছে। মজলিসী সাহিত্যের বাইরেও তিনি সৃজন নিবিষ্ট প্রচেষ্টায় প্রশংনীয়। সত্যনিষ্ঠা ও স্পষ্টবাদী গুণাবলির কারণে সুধীসমাজে গ্রহণযোগ্য অবস্থান করে নিয়েছেন। এছাড়া দেড় দশকের প্রকাশনা শিল্পে শুধু গ্রন্থ প্রকাশ নয়, তিনি গ্রন্থ নির্মাণের সাফল্য দেখিয়েছেন। সম্পাদনা, সাহিত্য ও প্রকাশনা জগতে তার সৃজনের দাগ এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের ১ মার্চ এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মরহুম মোহাম্মদ আবদুন নূর ও মা ফরিজা খাতুন। জন্মস্থান সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার পূর্ব ভাদেশ্বরের নালিউরি গ্রামে। দুই ভাই তিন বোনের মধ্যে তার অবস্থান চতুর্থ। একসময় সার্বক্ষণিক সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। বর্তমানে ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে স্থানীয় পত্রপত্রিকায় লিখে যাচ্ছেন। একাধিক গ্রন্থের লেখক বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল দেশ-বিদেশের প্রিন্ট-অনলাইন দৈনিক ও সাময়িকীতে তার প্রকাশিত বিচিত্রধর্মী প্রবন্ধ-নিবন্ধ বিদগ্ধ পাঠকদের মুগ্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন। নয়-এর দশকে একজন প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পী হিসেবে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রবেশ ঘটে। বিভিন্ন সাহিত্য আসর, আড্ডা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হাজিরা দিতে থাকেন হৃদ্যিক আকর্ষণে। আদর্শবিশ্বাস ও দেশাত্মবোধ তাকে মৌলিক সাহিত্যসাধনা ও প্রকাশনা শিল্পের মূলস্রোতে একাত্ম করে।
গবেষক বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল তাঁর গবেষণাগ্রন্থে সাহিত্যের প্রতিটি অঙ্গনে ডুব সাগরে ডুব দিয়ে বাঙালি জীবন ও বাংলাসাহিত্যের মূল্যবান ঝিনুক কুড়িয়েছেন। তিনি চেষ্টা করেছেন বাংলাসাহিত্যের ইতিহাস বর্ণনা গুণে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন। তার রচনায় সিলেটী কবি-সাহিত্যিকদের সার্থক চিত্র তাঁর বাস্তববাদী গবেষণায় একটি অমূল্য প্রয়াস। যা সাহিত্য ইতিহাসে সিলেটী সাহিত্যিকের শরব জীবনযাত্রার উপস্থিতির সংবাদ পাই। যা বাংলা ভাষাতত্ত্বের দিক থেকে বাংলাসাহিত্যের জন্য সাহিত্যের নিদর্শন। বাঙলা সাহিত্যের পক্ষে লেখকের এই গবেষণা সাহিত্যের মূল রূপটি ফুটে উঠেছে। বাংলাসাহিত্যে বাঙালি লেখক সমাজ বাংলাসাহিত্য রচনায় যώবান হবেন তখন স্বভাবতই বাঙালির ঐতিহ্য ফুটে উঠবে।
লেখক : কবি ও গবেষক