আমার দেখা ইংল্যান্ড : বাঙালির অনন্য কীর্তি ইষ্ট লন্ডন জামে মসজিদ
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ এপ্রিল ২০১৯, ৯:২৯ অপরাহ্ণ
আহবাব চৌধুরী খোকন:
৮ই জুলাই রবিবার লন্ডন সিটিতে ছিলো আমার শেষ দিন ।পরের দিন সকালের ফ্লাইটে প্যারিসের উদ্দেশ্যে লন্ডন ছাড়ার কথা ।রাতে সিন্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলাম শেষ দিন শুধু বন্ধু বান্ধব ও এলাকাবাসীর সাথে কাঠাবো।এই দিন ছিল আমার সাথে য়ুক্তরাজ্যস্থ ফেঞ্চুগন্জবাসীর পৃথক দুটি মতবিনিময় সভা।
প্রথমটি সকাল ১১ঠায় ইষ্ট লন্ডনের কফি হাউসে আর দ্বিতীয়টি ছিল রাত ৯ঠায় কমার্শিয়েল রোডের মাইকেল হালাল চাইনিজ রেষ্টুরেন্টে ।এখানকার ফেঞ্চুগন্জবাসী আয়োজিত এই দুটি সভায় গিয়ে এমন অনেকের সাথে দেখা হলো যাদের শুধু নাম শুনেছি দেখা হয়নি কখনো ।অনুষ্টানে গিয়ে দেখা হল বিশিষ্ট সমাজকর্মী জনাব ফারুক আলীর সাথে ।যিনি সুদুর রচডেল থেকে ছেলেকে নিয়ে এসেছেন আমার সাথে দেখা করতে । ফারুকভাই শারিরিক ভাবে খুব সুস্থ নয় ।হৃদরোগ আক্রান্ত হয়ে কিছু দিন হাসপাতালে ছিলেন । কিন্তু তারপরেও এত দুর থেকে এসে যে আন্তরিকতা দেখিয়েছেন তা আমার স্মরণ থাকবে সব সময় ।
ইংল্যান্ড পৌছার পর থেকে যারা প্রতিদিন ফোন করে শুধু যোগাযোগ রাখেননি আমার সুবিধা অসুবিধার ও খবর নিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন লন্ডনস্থ টাওয়ার হেমলেটের প্রাক্তন ডেপুটি মেয়র শ্রদ্ধেয় অহিদ আহমদ ,যুক্তরাজ্য বিএনপি সভাপতি আব্দুল মালিক এবং জিয়া স্মৃতি পাঠাগার ইউ কে এর সভাপতি শরিফুজ্জামান চৌধুরী তপন । আমি তাদের নিকট চীর কৃতজ্ঞ ।
ফেঞ্চগন্জের মতবিনিময় সভায় গিয়ে যাদের সাথে দেখা হলো তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন শ্রদ্ধেয় সর্ব জনাব টাওয়ার হেমলেটের প্রাক্তন ডেপুটি মেয়র অহিদ আহমদ, প্রাক্তন কাউন্সিলার আবু সামি সালেহ, বিশিষ্ট কমিউনিটি নেতা আফতার আহমদ, শাহ ফজলুর রব সুহেল, কাজী নমান আহমদ ,হেলাল উদ্দীন খান , মুহিবুল ইসলাম চৌধুরী কাপ্তান,ফারুক আলী, জাহাঙ্গীর খান, মোহাম্মদ আলমগির , দেওয়ান আলী আজগর , আলতা মিয়া ,হাজী হাবিব, শামসুল ইসলাম , মানিকুর রহমান গনী ,আনিছ চৌধুরী , মো আলমগীর, মুক্তাদির আলী , মাকছুদুল ইসলাম জিবুল,মুজাম্মেল হক সুনাম, জুবেদ আহমদ চৌধুরী , সাইদুর খালেদ, রাজু চৌধুরী ,আহাদ চৌধুরী আদনান, সুনাহর আলী রিংকু , আব্দুল করিম , আব্দুল আহাদ ,মো: রাবেল ,সাইফুর রহমান রবিন মো: কয়েছ আহমদ, নজরুল ইসলাম , সৈয়দ পলাশ আহমদ ,শাহ নেহাদুল ইসলাম শিপন , মো জানু মিয়া সৈয়দ সাহেদুজ জামান সাহেদ, রাজু চৌধুরী , লিপু চৌধুরী ,মো সুয়েব ইকবাল ,এ টি এম কবির,মোঃ রাজা মিয়া,আশরাফুল ইসলাম সাব্বির হাফিজ সুমন , আশরাফ উজ জামান রনি ,সোহেল আহমদ, কাজী কোরেস, আলাউদ্দীন ,আনিছুজ্জামান জনি, বাবেল আহমদ,মুক্তাদির আহমদ, লিটন আহমদ, চপল আহমদ, আল ফারুক গনি প্রমুখ ।
এই অনুষ্টান আয়োজনে যারা বিশেষ ভুমিকা পালন করে আমাকে চীর কৃতার্থ করেছেন তারা হচ্ছেন হচ্ছেন সাবেক ছাত্রনেতা শ্রদ্ধেয় শাহ ফজলুর রব সোহেল ও মকছুদুল ইসলাম জেবুল, মোজাম্মেল হক সুনাম, আদনান চৌধুরী আহাদ ও আশরাফুজ্জামাম রনি ।এই দুটি অনুষ্টান স্বল্প সময়ের মধ্যে লন্ডনে বসবাসরত অনেকের সাথে আমার দেখা করার সুযোগ করে দিয়েছে ।ভালো লেগেছে শ্রদ্ধেয় মুহিবুল চৌধুরী কাপ্তানভাই ও দেওয়ান জহি ভাইকে দীর্ঘ দিন পর দেখে ।কারণ এই দুইজন আমার অগ্রজ মামুম ভাইয়ের (সাবেক ছাত্রনেতা মামুন হোসেন চৌধুরী ) সহপাঠী ছিলেন ।কিন্তু ১৯৮৩ সালের পর তাঁদের সাথে আর দেখা হয়নি । দেখা হলো ফেঞ্চুগন্জের আরেক প্রবীন ব্যক্তিত্ব পাখিভাইয়ের (সোনা পাখি ) সাথে ।পাখিভাই অনেক দিন যাবৎ ইংল্যান্ডে আছেন । সেই ছোট বেলা থেকে উনার নাম শুনেছি কিন্তু এবারই প্রথম দেখা । প্রথম অনুষ্টানটি সকাল ১১ ঠায় হওয়ার কথা থাকলেও আমার অনুষ্টানস্থলে পৌছিতে দুপুর সাড়ে ১২ঠা বেজে যায় ।অনাকাঙ্কিত এই বিলম্বের জন্য অনেকে কষ্ট পেয়ে থাকলেও আমার কিছু করার ছিলো না ।কারণ লন্ডন সিটির যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্বন্ধে আমার কোন পূর্ব ধারণা ছিলো না ।সিটি থেকে আমার থাকার জায়গা হোটেলের দুরত্ব ছিলো মাত্র ১৫ মাইল ।এতটুকু জায়গা আসতে লেগেছে এক ঘন্টার ও উপরে ।এই সভায় উপস্থিত সকলের আন্তরিকতা ও আতিথেয়তা আমাকে চীর কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করেছে ।
দুপুরে ইষ্ট লন্ডনের খ্রীষ্টিয়ান রোডস্থ চিলড্রেন এডুকেশন সেন্টারে ছিল ফেঞ্চুগন্জের অন্যতম বিদ্যাপীঠ পি পি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্টান ।এই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র হিসাবে এই অনুষ্টানে যোগ দিয়ে যেন মনে হয়েছে ফিরে এসেছি ৩২ বছর পূর্বের সেই স্কুল জীবনে । ১৯৮১ থেকে ১৯৮৫ সান পর্যন্ত আমি এই স্কুলের ছাত্র ছিলাম ।সেই সময়ের অনেক মধুর স্মৃতি যেন আজো জমে আছে মনের গহিনে।পি পি এম মডেল উচ্চ বিদ্যালয় প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী পরিষদ কর্তৃক আয়োজিত এই অনুষ্টানটি হল ভর্তি ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতিতে পরিনত হয় একটি সত্যিকার মিলন মেলায়। অনুষ্টান সূচীর মধ্যে ছিল স্মৃতিচারণমূলক আলোচনা, শিশু কিশোরদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা , মহিলাদের মিউজিক্যাল পিলো ,কেক কাঠা,মহিলাদের মেহদির রঙ্গে হাত রাঙ্গানো, মধ্যান্হ ভোজ ও ফটো শেসন ইত্যাদি। উদযাপন কমিটির আহবায়ক সহপাঠী জনাব মোজাম্মেল হক সুনাম এর সভাপতিত্বে স্মৃতিচারন মুলক আলোচনায় অংশ নেন স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র চ্যানেল এস এর চেয়ারম্যন , ফেঞ্চুগন্জের সফল ব্যক্তিত্ব আহমেদ উস সামাদ চৌধুরী, প্রাক্তন শিক্ষক আব্দুল মোহিত , প্রাক্তন ছাত্র মুহিবুর রহমান চৌধুরী কাপ্তান,জহি দেওয়ান , শেফালী নাজমুন ,কুতুব উদ্দিন, আবুল কালাম সিবিল , শাহাব উদ্দিন, সায়েম,মারুফ চৌধুরী,উজ্জ্বল ,রাসেদ , হাসান চৌধুরী চপল আহমদ , এহসান চৌধুরী প্রমুখ।অনুষ্টান পরিচালনা করেন হাসনাত চৌধুরী বুলবুল ।আমি আমার বক্তব্যে স্কুলের এই মিলন মেলায় আমাকে আমন্ত্রন জানানোর জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানালাম ।শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করলাম আমার সেই সকল শিক্ষক ও প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের যারা আর এই ইহ জগতে নেই ।বিভিন্ন বক্তাদের স্মৃতিচারণে অনুষ্টানস্থল আবেগগন পরিবেশের সৃষ্টি হয় । দীর্ঘদিন পর স্কুলের বন্ধু, বান্ধব, সহপাটি এবং ছোট ও বড় অনেককে এক সাথে পেয়ে খুব ভালো লেগেছে ।
সময়ের স্বল্পতার জন্য স্কুলের পুরো অনুষ্টানটি উপস্থিত থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি ।তবে যতক্ষন ছিলাম অসম্ভব ভালো লেগেছে ।স্কুলের অনুষ্টান থেকে বের হয়ে দেখতে গেলাম প্রবাসী বাংলাদেশীদের অমর সৃষ্টি ইষ্ট লন্ডন জামে মসজিদ ।খোদ লন্ডন সিটির প্রাণ কেন্দ্রে অবস্থিত এই মসজিদটি সমগ্র ইউরোপের বৃহত্তম মসজিদ ।ইষ্ট লন্ডনের হোহাইট চ্যাপল এবং অলগেটের মধ্যবর্তী লন্ডন বরো অব টাওয়ার হ্যামলেটস এ অবস্থিত এই মসজিদ ।মসজিদটি বাহির থেকে দেখতে যতোটা চাকচিক্যময় মনে হয় ভিতরের স্থাপত্য শৈলী আরো সুন্দর ।বেশ বড় জায়গা নিয়ে প্রতিষ্টিত এই মসজিদের চারিদিকে অনেক বাড়ী ঘর রয়েছে এই মসজিদের মালিকানায ।মসজিদে জামাতে চার রাকাত আছরের নামাজ পড়ে মনে হল এটি আমাদের জন্য অহংকার করার মত একটি প্রতিষ্টান ,যেখানে একত্রে দশ হাজার মুসল্লী নামাজ পড়তে পারেন। ইষ্ট লন্ডন মসজিদ শুধু নামাজের স্থান হিসাবে ব্যবহৃত হয় না ।এখানে পরিচালিত হয় কমিউনিটির বহুমুখী কর্মকান্ড ।গোঠা ইউরোপের বৃহত্তম মসজিদ হওয়াতে এই মসজিদটি বৃটেনের মূলধারায় বিশেষ প্রাধান্য পেয়ে থাকে । মসজিদের প্রায় কাছেই অবস্থিত হচ্ছে শহীদ আলতাফ আলী পার্ক ।এই পার্ক এখন বাঙ্গালীদের দাবী আদায়ের পাদপীঠ হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে ।শহীদ আলতাফ আলী ছিলেন বৃটেনের কারখানায় কর্মরত একজন বাংলাদেশী শ্রমিক ।১৯৭৮ সালের ৪ঠা মে কাজ থেকে বাড়ী ফিরার পথে পূর্ব লন্ডনের এলডার ষ্টিটে বর্ণবাদীদের হামলায় খুন হন ।তাঁর নামানুসারে ১৯৯৮ সালে পূর্ব লন্ডনের এল্ডার স্টিটস্থ সেন্ট মেরিস পার্কের নামকরন করা হয় শহীদ আলতাফ আলী পার্ক ।এই পার্কের অভ্যন্তরে রয়েছে শহীদ মিনার ।এটি বর্হিবিশ্বের সবচেয়ে বড় শহীদ মিনার হিসাবে স্বীকৃত ।
আলতাফ আলী পার্ক থেকে বের হয়ে দেখতে গেলাম লন্ডনের ১২৩ বছরের ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক টাওয়ার ব্রীজ ।আমর ভাগিনা রওনক আমাদেরকে নিয়ে গেলো টাওয়ার ব্রিজ দেখাতে ।এবার লন্ডনে এসে আমার দুই ভাগিনা রওনক ও রুয়েতের সাথে দীর্ঘ দিন
পর দেখা হলো । প্রত্যাহিক ব্যস্ততার মাঝে আমার যে দুই ভাগিনা লন্ডন থাকে প্রায় ভুলেই বসেছিলাম। চোখে পড়লো অসংখ্য পর্যটক যারা এসেছে এই ব্রীজ দেখতে এবং ছবি তোলতে ।জানা যায় অত্যধিক জনসংখ্যার চাপে এক সময় যখন লন্ডন জনবহুল হয়ে উটেছিলো তখন নগরীর উপর বর্ধিত জনসংখ্যার চাপ কমাতে ১৮৮৬ সালে এই ব্রীজ নির্মান করা হয় ।তখনকার সময় এই ব্রীজ নির্মান করতে ব্যয় হয়েছিলো ১১ লাখ ৮৪ হাজার পাউন্ট । ৫৬ মিটার উচ্চতা সম্পন্ন দুটি বিশাল টাওয়ারের উপর নির্মিত এই ব্রীজের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে যখন টেমন নদী দিয়ে বিশাল আকৃতির জাহাজ আসে তখন এই ব্রীজের মূল অংশ মাঝ বরাবর উপরের দিকে উটে য়ায়।ফলে ব্রিজের নীচ দিয়ে জাহাজ চলাচলে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় না । রাতের সময় এই ব্রীজ খুব সুন্দর দেখায় এবং এই ব্রীজ থেকে লন্ডন সিটি অবলিলায় অবলোকন করা যায় ।টাওয়ার হেমলেট ব্রীজ দেখে আমরা চলে আসি হোহাইট চাপলের বাঙ্গালী পাড়ায় ।এখানে আমার গাঁও রেষ্টুরেন্টে পরিবেশিত গরম গরম চা ও পিয়াজু যেন সারা দিনের ক্লান্তি দূর করে দেয় ।রাত ৯ঠায় যোগদান করতে হয় কমার্শিয়েল রোডের মাইকেল হালাল চাইনিজ রেষ্টুরেন্টে একটি অনুষ্টানে ।এখানে যুক্তরাজ্যস্থ ফেঞ্চুগন্জবাসীর সাথে আমার একটি মতবিনিময় সভা ছিল । রাতে অনুষ্টানের ফাকে আমাকে লন্ডনের বিশিষ্ট কমিউনিটি এক্টিভিষ্ট, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব জনাব মানিকুর রহমান গনি ও মুহিবুর রহমান চৌধুরী নিয়ে গেলেন লন্ডনস্থ বাংলা বেতারের স্টুডিওতে ।এখানে কর্তব্যরত কর্মকর্তাবৃন্দ আমাকে তাদের কার্যক্রম ঘুরে দেখালেন।ফেঞ্চুগন্জের এই মতবিনিময় সভা শেষ হয় রাত ২ঠায় ।এখান থেকে সকলের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে রওনকের বাসা হয়ে ভোর চার টায় ভাগিনা রুয়েত আমাকে নামিয়ে দেয় লন্ডনের গেটউইক ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে ।এই দিন সকাল ৫ঠার ফ্লাইটে লন্ডন ছাড়ি প্যারিসের উদ্দেশ্যে আর এভাবেই সারা রাত নির্ঘুম ঘুরাঘুরির মধ্য দিয়ে শেষ হয় আমার দুদিনের লন্ডন সফর ।
।। চলবে ।।
লেখক – সংগঠক ও কলাম লেখক , নিউইযর্ক ।