আমার দেখা ইংল্যান্ড, লন্ডন চমৎকার একটি পর্যটন নগরী।। পর্ব-৩
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ মার্চ ২০১৯, ১১:৫৯ পূর্বাহ্ণ
আহবাব চৌধুরী খোকন :
বিশ্বের অন্যতম একটি ব্যস্ত বানিজ্যিক নগরীর নাম লন্ডন ।প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার পর্যটক ভ্রমন করতে আসেন এই নগরী ।লন্ডন সিটিতে পৌছে দেখতে গেলাম এখানকার কিছু দর্শনীয় স্থান ।চাচা আহাদ চৌধুরী আমাদেরকে এখানকার বিখ্যাত স্থান গুলো ঘুরে দেখালেন ।লন্ডন সিটিতে চলাফেরার জন্য সবচেয়ে সহজ যোগাযোগ মাধ্যম হচ্ছে আন্ডার গ্রাউন্ট ট্রেন ।আমরা গাড়ী রেখে এই ট্রেনে করেই বের হলাম শহর পরিভ্রমনে ।লন্ডন আমার দেখা খুব চমৎকার একটি শহর ।পৃথিবীর ২০০০ বছরের পুরনো শহর এটি ।এক সময় এটি ছিলো রাজা অষ্টম হেনরীর অবকাশ স্থান ।
প্রথম দর্শনেই লন্ডনের টেমস নদী যে কাউকে মুগ্ধ করবে ।ইতিহাস ঘেটে দেখলাম লন্ডন শহরের বিস্ময়কর উন্নতির পেছনে খরস্রোতা এই টেমস নদী স্মরণাতীত কাল থেকে বিরাট ভুমিকা পালন করে আসছে ।সিটির সিংহভাগ অংশ হচ্ছে এই নদীর তীরে ।এক সময় লন্ডন নৌবানিজ্যের জন্য বিখ্যাত ছিল ।তখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিশাল বিশাল জাহাজ গুলো এসে নোঙ্গর করতো এই টেমস নদী তীরবর্তী লন্ডন সিটিতে।এখন এই নৌবানিজ্যের সেই জৌলুস আর না থাকলেও টেমস নদীর গুরুত্ব এতটুকুও কমেনি ।কালক্রমে টেমস নদী এখন পরিনত হয়েছে বানিজ্যিক নদীতে ।প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসেন এই নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে ।টেমস নদীতে চলাচল কারী ক্রোজ লাইন গুলো পর্যটক আকর্ষনে যেমন সুনাম অর্জন করেছে তেমনি অর্জন করে থাকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ।ব্রিটিশ লোক সাহিত্যে টেমস নদীর অবদান রয়েছে ।অসংখ্য লেখক, কবি, সাহিত্যিক, গবেষক ও সঙ্গীতঙ্গ এই নদীকে চিত্রিত করেছেন তাদের লেখায় গবেষনায় ,সাহিত্যকর্মে ।ইংল্যান্ডের বহু রাজা ও রানী টেমস নদী তীরে দূর্গ ও কেল্লা নির্মান করে ইতিহাসে আজও অমর হয়ে আছেন ।লন্ডনের একটি অন্যতম আকর্ষনীয় পর্যটন কেন্দ্রের নাম হচ্ছে লন্ডন আই । আমার মেয়ে রাইদা ও আকিদা নিউইয়র্ক থেকে পরিকল্পনা করে এসেছে যে দুটি জায়গা দেখতে তাদের মধ্যে হলো লন্ডন আই ও বাকিংহাম প্যালেস।টেমস নদীর তীর ঘেষে অবস্থিত লন্ডন আই দেখতে ছবির মতো সুন্দর একটি পর্যটন কেন্দ্র ।এই পার্কটি একেবারেই নতুন ।বিশাল জায়গা নিয়ে নির্মিত এই পর্যটন স্পটটি মাত্র উনিশ বছর আগে পর্যটকদের জন্য উন্মোক্ত করে দেওয়া হয়েছে । এর অভ্যন্তরে রয়েছে বিশ্বের সব চেয়ে উচু নগরদোলা ও সর্বচ্ছো ভিউয়িং পয়েন্ট।যেখান থেকে সমগ্র লন্ডন সিটি অনায়াসে দেখা যায় ।তাই কোন পর্যটকই সর্বচ্ছো এই উচু স্থানে উটে পুরো সিটি দেখার এই সুযোগ হাত ছাড়া করতে চায় না ।
লন্ডন আই দেখে আমরা রওয়ানা হলাম বাকিংহাম প্যালেসের উদ্দেশ্যে ।এক জায়গা থেকে আরেক জায়গার দুরত্ব অর্ধ মাইলের কম হবে না ।লন্ডনের ওয়েষ্ট মিনিষ্টার শহরের এই বাকিংহাম প্যালেস হচ্ছে ব্রিটেনের রাজতন্ত্র ও রাজকীয় আভিজাত্যের প্রতিক ।এই প্যালেস হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম বিশাল বহুল একটি রাজপ্রাসাদ ।বৃটেনের সকল রাষ্ট্রীয় অনুষ্টানাদি এই ভবনে অনুষ্টিত হয়ে থাকে ।এখানকার ভিতরের কক্ষ গুলো রাষ্ট্রীয় অফিস হিসাবে ব্যবহৃত হয় ।১৮৩৭ সালে এই ভবনটি ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের বাসভবন হিসাবে আত্ন প্রকাশ করে ।রানী ভিক্টোরিয়া যখন সিংহাসনে আরোহন করেন তখন এই প্যালেসের পরিচয় বদলে যায় ।প্যালেসের পিছনে রয়েছে নয়নাভিরাম গার্ডেন ।রয়েছে লেক ।এখানে সকল রাষ্ট্রীয় অনুষ্টান সমুহ উদযাপিত হয়ে থাকে।৭৭০০০ বর্গমিটার এলাকা জুড়ে বিস্থৃত এই প্যালেস হচ্ছে পৃথিবীর ১০তম রাজ প্রাসাদ ।প্রাসাদের অভ্যন্তরে রয়েছে ৭৭৫ টি কক্ষ ।যার মধ্যে ১১৮ টি কক্ষ হচ্ছে কর্মচারীদের জন্য, ৯২ টি অফিস কক্ষ, ৭৮টি শৌচাগার ,৫২টি প্রধান কক্ষ, ১৯টি অতিথি শালা, প্রাসাদের অভ্যন্তরে আছে পৌষ্ট অফিস, সুইমিংপুল, সিনেমাহল, এছাড়া রানীর গ্যালারিতে রয়েছে ৭০০০ টি বিখ্যাত চিত্রকর্ম ।বাকিংহাম প্যালেসের সামানের রাস্তা লাল রংয়ের হওয়ায় মনে হয় পুরো রাস্তা যেন লালা গালিচায় আচ্ছাদিত ।এক সময় এই প্যালেস কেবল উচু শ্রেনীর লোকদের জন্য সংরক্ষিত ছিল ।বর্তমান রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের সময় থেকে এই প্রসাদকে সকল শ্রেনীর নাগরিকদের জন্য উন্মোক্ত করে দেওয়া হয় ।এই প্রাসাদে রয়েছে একটি বিশাল বলরুম ।বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রীয় পুরস্কার বিতরনী অনুষ্টান রানীর উপস্থিতিতে এই বলরুমে অনুষ্টিত হয়ে থাকে ।তাছাড়া কখনো কোন দেশের রাষ্ট্র কিংবা সরকার প্রধান ইংল্যান্ড সফরে এলে বৃটিশ রীতি অনুযায়ী তাঁর সংবর্ধনা এই বলরুমে হয়ে থাকে ।বর্তমানে বাকিংহাম প্যালেস বৃটেনের শাসনতান্ত্রিক কেন্দ্র বিন্দু হিসাবে সমাদৃত হয়ে থাকে ।প্রতিদিন এখানে সাড়ে চারশত সরকারী কর্মকর্তাও কর্মচারী কাজ করে থাকে ।
আমরা দেখতে গেলাম টেমস নদী তীরে অবস্থিত টাওয়ার অব লন্ডন ।টাওয়ার অব লন্ডন মূলত বেশ কয়েকটি টাওয়ারের সমন্বয়ে গঠিত মধ্য লন্ডনের একটি ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান ।ইংল্যান্ডের গৌরবময় ইতিহাসের সাক্ষী হচ্ছে এই টাওয়ার অব লন্ডন ।সম্রাট উইলিয়াম ১০৭০ সালে যখন এই দূর্গ তৈরীর আদেশ দিয়েছিলেন তখন তিনি চেয়েছিলেন এই দূর্গ হবে ক্ষমতার প্রতিভূ স্বরুপ এবং ক্ষমতা সুরক্ষার প্রথম ও প্রধান কেন্দ্র ।চোখে পড়লো লন্ডনের বিখ্যাত সেই বিগ বেন ঘড়ি ।ওয়েষ্ট মিনিষ্টারে অবস্থিত এই বিগ বেন নামের এই বিশাল আকৃতির ঘড়িটি এখন পরিচিতি বহন করে লন্ডনের ট্রেডমার্ক হিসাবে ।পর্যটকরা ব্যস্ত ইতিহাসের সাক্ষি এই বিখ্যাত বিগবেনের ছবি তোলতে ।দেখলাম হাইড পার্ক ।যেখানে রয়েছে পায়ে হাটার পথ, সাইকেল চালানোর জন্য বিস্থৃত জায়গা আর বিচিত্র ধরনের গাছগাছালি ।পাশে রয়েছে লিডো লেক ।যেখানে চাইলেই কেউ সাতার কাঠতে পারবেন ।দেখলাম হাজারো পর্যটক লেকের পারে বসে উপভোগ করছে এর সৌন্দর্য ।এখানে এলে চোখে পড়বে লেকের পানিতে ভেসে বেড়ানো রাজ হাঁসের দল আর পর্যটকদের চড়ে বেড়ানোর জন্য নানা জাতের পানসি নৌকা ।দেখে এলাম আলবার্ট মেমোরিয়াম ।এটি মূলত একটি স্মৃতি সৌধ ।মহারানী ভিক্টোরিয়ার স্বামী স্মরণে এই সৌধটি এক সময় নির্মিত হয়েছিলো ।এটি নির্মান করতে নাকি ব্যয় হয়েছে দেড় লক্ষ পাউন্ট এবং সময় লেগেছিল বিশ বছর । একই এলাকায় রয়েছে লন্ডন এ্যাকুরিয়াম ।এটি ইংল্যান্ডের সর্ববৃহৎ এ্যাকুরিয়াম ।এই এ্যাকুরিয়ামে রয়েছে চারশত জলজ প্রাণী ।জীব জগতের বিপুল শিক্ষনীয় অভিজ্ঞতা এই এ্যাকুরিয়াম থেকে পর্যটকরা অর্জন করে থাকেন ।রাস্তা ধরে যাওয়ার সময় বাহির থেকে চোখে পড়লো ১১ নং ডাইনিং স্টিটের প্রাইম মিনিষ্টার হাউস, পর্যটকদের প্রিয় স্থান ট্রাফলিগার স্কয়ার ,সামারসেট হাউস, ও কেনসিংটন প্যালেস ।লন্ডন সিটিতে দেখার মতো এত জায়গা আছে যে এক সপ্তাহ ঘুরে বেড়ালেও শেষ হওয়ার নয় ।রাত ১০টায় আমরা আবার আন্ডার গ্রাউন্ড ট্রেন ধরে ফিরে এলাম সিটিতে ।রাতে আমার গিন্নির এক বান্ধবী মিসেস সালেহ আহমদের বাসায় ছিল ডিনারের দাওয়াত ।কিন্তু জরুরী প্রয়োজনে আমাকে আবারো লোটন যেতে হয় ।ফলে গিন্নি ও বাচ্চাদেরকে দাওয়াতে পাঠিয়ে চলে আসি লোটন । আমাদের রাত্রী যাপনের জায়গা ডাবোল ট্রি হোটেল ছিল সিটি থেকে প্রায় পনের মাইল দুরে ওকিং সিটিতে । লন্ডন থেকে লোটন আবার লোটন থেকে আমি যখন রাত্রী যাপনের জন্য ফিরে আসি হোটেলে তখন সময় ভোর রাত ৩ঠা।আর এভাবেই বিরামহীন ঘুরাঘুরির মধ্য দিয়ে কেঠে গেলো পুরো দিন ও রাত ।