পদ ধরে রাখতে ‘বিয়ে গোপন’ : কেন্দ্রের নির্দেশ উপেক্ষিত সিলেট জেলা ছাত্রলীগে
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ আগস্ট ২০১৭, ২:২৬ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ:
কিছুদিন ধরে ছাত্রলীগের নানা কর্মকান্ডে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। নিজেদের মধ্যে সংঘাত দ্বন্দ্ব থেকে শুরু করে নানা বিতর্কিত কর্মকান্ডে জড়িয়ে তারা আলোচনায় এসেছেন। সাংবিধানিক রীতিনীতি লঙ্ঘন আর অযোগ্য ও অনিয়ম তান্ত্রিকভাবে ছাত্রলীগে অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাওয়া কিছু কর্মীদের নিয়েও দেখা দিয়েছে নানা আশঙ্কা। পাশাপাশি ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের পরিপন্থি কিছু কর্মকান্ড ও আলোচনা সমালোচনায় জন্ম দিয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম একটি বিষয় হচ্ছে বিবাহিত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দলে বহাল রাখা। যেসব নেতাকর্মী কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশ অমান্য করে ক্ষমতা আঁকড়ে বসে আছেন।
নেতৃত্বের জন্য তাদের কেউ কেউ বিয়েই অস্বীকার করে বসেছেন। তারা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নির্দেশকে পাত্তা দিচ্ছেননা। কেন্দ্র থেকে ছাত্রলীগের সকল ইউনিটের বিবাহিত নেতাদের ৪৮ থেকে ৭২ ঘন্টার মধ্যে পদত্যাগের নিদের্শ দেওয়া হয়েছিলো চলতি বছরের ১২ জুলাই। এ নির্দেশের পর প্রায় একমাস পার হয়ে গেলেও তেমন কোন সাঁড়া নেই। এ সময়ের মধ্যে সিলেট জেলা ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করেছেন মাত্র দুই বিবাহিত নেতা। যদিও জেলা ছাত্রলীগের বিভিন্নসূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী আরও অন্তত ৪জন বিবাহিত নেতা পদ আঁকড়ে ধরে আছেন। তাদের মধ্যে আছেন সভাপতি শাহরীয়ার আলম সামাদও, যদিও তিনি ‘বিবাহিত’র অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
উপজেলা পর্যায়ের অবস্থা আরও খারাপ। কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের নির্দেশের পর সিলেট জেলার কেবলমাত্র বালাগঞ্জ উপজেলার ১৪জন বিবাহিত নেতা পদ ছেড়েছেন। আর কোন উপজেলা থেকে কেউ পদত্যাগ করেছেন কি-না সে তথ্যও জানাতে পারেননি সিলেট জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি।
সিলেট জেলা ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটি ঘোষণা করা হয়া ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকে। এর ১৫ মাস পর, ২০১৫ সালের ৫ ডিসেম্বর ১৪১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। অবশ্য কমিটি ঘোষণার পর থেকেই তারা নানা বিতর্কিত কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে তাদের সামাল দেওয়াই দায় অবস্থা দাঁড়ালে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়। স্থগিত করা হয় সিলেট জেলা ছাত্রলীগের কমিটি। কিন্তু তবু তাদের সামাল দেওয়া যায়নি। এ অবস্থায়, ৮ মাস পর গত ডিসেম্বরের ১১ তারিখ স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।
১২ জুলাই এক সিদ্ধান্ত জানান বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। তারা ছাত্রলীগের প্রতিটি ইউনিট থেকে বিবাহিত নেতাদের পদত্যাগের নির্দেশ দেন। এমনকি, তারা এ নির্দেশ কার্যকরের জন্য সময়ও বেধেঁ দিয়েছিলেন। তাদের নির্দেশ ছিলো ৪৮ থেকে ৭২ ঘন্টার মধ্যে বিবাহিতদের পদত্যাগ করতে হবে। কিন্তু পদত্যাগ না করলে কি ব্যবস্থা নেয়া হবে, সে ব্যাপারে কোন নির্দেশনা ছিলোনা। আর তাই যা হওয়ার তাই হয়েছে। নির্দেশ বা আল্টিমেটামকে কেউ পাত্তা দেয়নি। সিলেট জেলা ছাত্রলীগ থেকে দুইজন মাত্র পদত্যাগ করেছেন। যে দুইজন পদত্যাগ করেছেন, তাদেরও সঠিক পরিচয় জানাতে পারেননি জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি শাহরিয়ার আলম সামাদ। আর বালাগঞ্জ ছাড়া অন্যকোন উপজেলা থেকে কেউ পদত্যাগই করেননি। এ উপজেলা থেকে মাত্র ১৪ জন বিবাহিত নেতা পদ ছেড়েছেন। সিলেটের চিত্র থেকে সারাদেশের চিত্রটা অনুমান করতে পাঠকের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
এদিকে, সিলেট জেলা ছাত্রলীগের বিভিন্নসূত্রে জানা গেছে, দুই জন পদত্যাগের পরও এখনও অন্তত ৪ জন বিবাহিত নেতা রয়েছেন কমিটিতে। তারা হচ্ছেন, সভাপতি শাহরীয়ার আলম সামাদ, সহ সভাপতি সুলেমান হোসেন চৌধুরী, সহ সম্পাদক মারুফুল হাসান মারুফ ও উপ গণশিক্ষা সম্পাদক মো. তানভির হোসেন। এর মধ্যে সুলেমান ও মারুফ একটি করে সন্তানের জনক বলেও জানিয়েছে ছাত্রলীগের ঐ সূত্র।
সিলেট জেলা ছাত্রলীগের কমিটি অনুমোদনের পরপরই অবশ্য নেতাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন বর্তমান কমিটিরই একাংশের নেতৃবৃন্দ। তারা এই কমিটি মেনে নিতে পারেননি। তাদের অভিযোগ ছিলো কমিটিতে শহীদ মিনার ভাঙ্গায় অভিযুক্ত, অছাত্র, বিবাহিত, ইভটিজার, ছিনতাইকারী, প্রতারক, অশিক্ষিত, এবং ছাত্রদল ও ছাত্র শিবির থেকে অনেক অনুপ্রবেশকারী রয়েছে। এদের বাদ দেয়ার দাবিতে ঐ অংশের নেতৃবৃন্দ ২০১৫ সালের ১০ ডিসেম্বর নগরীর একটি অভিজাত হোটেলে সংবাদ সম্মেলনও করেছিলেন। এ নিয়ে তারা অনেক আন্দোলন কর্মসূচি পালন করলেও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ কোন পদক্ষেপ গ্রহন করেনি।
এদিকে জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলন নিয়েও ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। কেন্দ্র থেকে তারিখ ঘোষণা করা হলেও পরে আবার তা পরিবর্তন করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ৩বার তারিখ ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ, কিন্তু সম্মেলন আর হয়নি। প্রথম তারিখ নির্ধরণ করা হয়েছিলো চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি, এই মর্মে ১১ ডিসেম্বর ২০১৭ কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও এস এম জাকির হোসেন স্বাক্ষরিত এক পত্রে সার্বিক প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো। পরে ১৮ ফেব্র“য়ারি স্বাক্ষরিত আরেকটি পত্রে ১৮ মার্চ শনিবার সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করে নির্দেশনা দেওয়া হলেও, এ তারিখেও তা হয়নি। সবশেষে, গত ১৩ মার্চ স্বাক্ষরিত আরেকটি পত্রে নতুন তারিখ নির্ধারণ করা হয় চলতি বছরের ২২ এপ্রিল কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এ তারিখেও সম্মেলন হয়নি।
বিবাহিত নেতাদের পদ না ছাড়া এবং তারিখের পর তারিখ নির্ধারণ সত্ত্বেও সম্মেলণ না হওয়ার কারণ সম্পর্কে সিলেট জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি শাহরীয়ার আলম সামাদ বলেন, ‘বালাগঞ্জ উপজেলা থেকে ১৪ ও সিলেট জেলা ছাত্রলীগ থেকে ২ জন বিবাহিত নেতা পদত্যাগ করেছেন। জেলা ছাত্রলীগে আর কোন বিবাহিত নেতা আছেন বলে আমার জানা নেই। যদি কেউ থাকেন এবং আমরা প্রমাণ পাই, তাহলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে বা অব্যাহতি দিতে বাধ্য থাকবো।’ তিনি নিজে বিবাহিত কি-না জানতে চাইলে সামাদ বলেন, ‘আমি বিবাহিত নই। একবছর আগেই আমি এ ব্যাপারে চ্যালেঞ্জ করেছি। তেমন প্রমাণ কেউ দিতে পারলে আমি সাথে সাথে পদত্যাগ করবো।’
আর সম্মেলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সম্মেলনতো কেন্দ্রের ব্যাপার। তারা যখন পারবেন, করবেন।’ তারিখ দিয়ে পিছানোর কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের যখন সময় হবে তখন তারা সম্মেলন করবেন।’ তিনি আরও জানিয়েছেন, ‘উপজেলা, পৌরসভা ও কলেজ মিলিয়ে মোট ৩১টি ইউনিটের মধ্যে ১৯টি ইউনিটের কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগস্টের পর অন্য ১২টি ইউনিটেরও কমিটি করে দেওয়া হবে।’
নিজের বিয়ের বিষয়টি অস্বীকার করলেও তার বিয়ের কাবিনের ফটোকপি (বিবাহ নং ১০৪/২০১৫, বালাম নং ২/খ/২০১৫, পৃষ্ঠা নং ০৫, তারিখ ০৫/১১/২০১৫) শ্যামল সিলেটে সংরক্ষিত আছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসেনের বক্তব্য জানার জন্য বেশ কয়েকবার তার ব্যাক্তিগত মোবাইল নম্বরে কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগের মোবাইলেও কয়েকবার কল দেয়া হলেও একই অবস্থা। কেউ ফোন ধরেননা অথবা কেটে দেন। সূত্র- শ্যামল সিলেট