ষোড়শ সংশোধনীর রায় এবং তির্যক বাক্যবাণে জর্জরিত একজন প্রধান বিচারপতি !
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ আগস্ট ২০১৭, ১২:৫৮ পূর্বাহ্ণ
সুহেল আহমদ চৌধুরী:
ষোড়শ সংশোধনী এখন গণমাধ্যমে সবচেয়ে আলোচিত শব্দ। কি ছিল এই ষোড়শ সংশোধনীতে যার কারণে রাষ্ট্রের নির্বাহী থেকে শুরু করে আদালত কর্তৃক দণ্ডপ্রাপ্ত মন্ত্রী পর্যন্ত তির্যক বাক্য ছুড়েন প্রধান বিচারপতির প্রতি। ক্ষমতাসীনদের প্রত্যেকটি ইউনিটের নেতা কর্মী ক্ষুব্ধ। শুধু নেতা কর্মী নয় কোন কোন সাবেক বিচারপতিরাও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। কেউ কেউ নিজেদের মন্তব্যে শালীনতার মাত্রাও ছাড়িয়ে গেছেন। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় দেওয়ার ১৬ মাস পরে সংক্ষিপ্ত রায়ের সাথে গড়মিল করে পুর্নাঙ্গ রায় প্রকাশের জন্য আলোচিত সাবেক প্রধান বিচারপতি এ.বি. এম খায়রুল হক, যুক্তরাজ্যে শারীরিকভাবে লাঞ্ছনার শিকার সাবেক বিচারপতি মানিক সহ সরকার এবং বিরোধী দলের শতাধিক নেতা নিজেদের ক্ষুব্ধ ব্যক্ত করেছেন। এরমধ্যে আদালত অবমাননার দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামী, বর্তমান খাদ্য মন্ত্রী প্রধান বিচারপতির অপসারণও দাবী করেছেন। একজন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামী মন্ত্রী থাকেন কিভাবে এবং যে আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত সেই আদালতের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন কিভাবে ?
বাহাত্তরের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনঃ স্থাপনের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদকে ফিরিয়ে দেয়া। এটাই ছিল ষোড়শ সংশোধনী। ষোড়শ সংশোধনী আইন ২০১৪ বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে সংসদে উত্থাপন করেন এবং ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে ৩২৮ ভোটে পাস হয়। বাংলাদেশ সংবিধানের এ পর্যন্ত ১৬ বার সংশোধনী আইন সংসদে পাস হয়েছে। এর মধ্যে পঞ্চম, সপ্তম, ত্রয়োদশ এবং ষোড়শ সংশোধনী সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক অবৈধ ঘোষিত এবং বাতিলকৃত।
বিগত ২০১৬ সালের ২৫ মার্চ ভারতের জনপ্রিয় দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার এক নিবন্ধের উদ্ধৃতি দিয়ে দৈনিক যুগান্তর প্রকাশ করে বাংলাদেশ কে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রমাণ করতে বর্তমান সরকার প্রধান ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি হিন্দু ধর্মাবলম্বী আইনজীবী সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব দেন। দৈনিকটি উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতির অবস্থান রাষ্ট্রপতির ঠিক এক ধাপ নিচে। পিতার মতোই প্রধান বিচারপতিকেই রাষ্ট্রপতি করাটা পছন্দ করেন রাষ্ট্রের নির্বাহী । এতে সুবিধা দু’দিকে। এক. রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখা। দুই. একজন আইনজ্ঞকে অভিভাবক হিসেবে পাওয়া। ভারতে প্রথম সংখ্যালঘু রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন মুহাম্মদ হিদায়তুল্লাহ ১৯৬৯-এ। তিনি সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন।’
যা কে রাষ্ট্রের নির্বাহী পরবর্তী রাষ্ট্রপতি মনোনীত করার খায়েশে প্রধান বিচারপতির পদে পদায়ণ করেন মাত্র একটি রায়ের কারণে তিনি কিভাবে খাদে পড়ে যান?! এখানে অংকটি বেশ জটিল !! রায়ে প্রকাশের পর দীর্ঘদিন ক্ষমতাসীনরা মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন, যে দিন মন্ত্রী সভার বৈঠকে রাষ্ট্রের নির্বাহী রায়ের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের পরামর্শ দেন এরপর থেকে তির্যক বাক্য বৃষ্টির ফল্গু ধারা অব্যাহত রেখেছেন ক্ষমতাসীনরা। একটি ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদক রায় খসড়া করে দিয়েছেন বলেও মন্তব্য করেছেন ক্ষমতাসীনরা।
রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি লিখেছেন ‘কোনো জাতি বা দেশ কোনো এক ব্যক্তিকে দিয়ে গড়ে ওঠে না, কিংবা কোনো একজন দ্বারা তা গঠিতও হয় না। আমরা যদি সত্যিই জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলায় বাঁচতে চাই, তাহলে অবশ্যই আমাদেরকে আমিত্বের আসক্তি এবং এই আত্মঘাতী অভিপ্রায় থেকে মুক্ত হতে হবে।’
আর এ কারণে রায়ে বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে বলে ক্ষমতাসীনরা অভিযোগ করে প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ থেকে তা এক্সপাঞ্জ করা দাবী তুলেছেন। ৭৯৯ পৃষ্ঠার রায়ে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম বিচারপতিদের পর্যবেক্ষণে মোট ১১ বার এসেছে। এর মধ্যে সর্বাধিক পাঁচবারই উল্লেখিত হয়েছে প্রধান বিচারপতির অংশে। বঙ্গবন্ধু শব্দটি মোট এসেছে নয়বার। এর মধ্যে প্রধান বিচারপতি একাই উল্লেখ করেছেন তিনবার (পৃষ্ঠা ৩০, ১৪০ ও ২২৬)। তিনি ৩০, ৫৪ ও ২০০ নম্বর পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির জনক’ হিসেবেও বর্ণনা করেছেন।
রায়ে প্রধান বিচারপতি লিখেছেন সংসদের ফ্লোরে রায়ের সমালোচনা হয়েছে অসংসদীয় ভাষায়। এটা প্রমাণ করে যে, আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্র অপরিপক্ব এবং পরিপক্বতা অর্জন করতে হলে ধারাবাহিকভাবে অন্তত ৪/৫ মেয়াদে সংসদীয় গণতন্ত্র অনুশীলন করার প্রয়োজন রয়েছে।’ কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তিনি সংসদ বা সাংসদদের ‘অপরিপক্ব’ বলেছেন। এমন কি তার নিয়োগও অবৈধ বলছেন কেউ কেউ ।
রায়ে দু’টি অংশ থাকে একটি আদেশ এবং অপরটি পর্যবেক্ষণ। ষোড়শ সংশোধনীর আদেশ নিয়ে যতটা আলোচনা তার চেয়ে অধিক আলোচনা রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে। পুর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর ক্ষমতাসীনরা যে সমস্ত তির্যক মন্তব্য ছুড়েছেন তা নজিরবিহীন । সন্দেহ নেই তাতে বিচার বিভাগীয় ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে। এতে পরবর্তীতে স্বাধীন বিচারেও প্রভাব পড়তে পারে। ভবিষ্যতে কোন বিচারপতি আর নিরপেক্ষভাবে আদেশ কিংবা পর্যবেক্ষণ কতটা দিতে পারেন সেটি এখন দেখার বিষয়। আমি এখানে কয়েকজনের মন্তব্য উল্লেখ করা চেষ্টা করেছি।
ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের খসড়া করেছেন একটি পত্রিকার সম্পাদক……….. তাপস
ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর্যবেক্ষণে ইতিহাস বিকৃতি হয়েছে …আইনমন্ত্রী
ষোড়শ সংশোধনী রায়ের কিছু অংশ অপ্রাসঙ্গিক………….আব্দুল মতিন খসরু
ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় ঐতিহাসিক দুর্ঘটনা…………….. নৌ মন্ত্রী
ষোড়শ সংশোধনীর রায় ষড়যন্ত্রমূলক ………………. স্বাস্থ্যমন্ত্রী
ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় ‘মতলবি রায়’…. মতিয়া চৌধুরী
বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ অপ্রাসঙ্গিক: তোফায়েল
ষোড়শ সংশোধনীর রায় ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’…. বিচারপতি মানিক
যারা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না তারাই বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করছে ….. শামীম ওসমান
ষোড়শ সংশোধনীর রায় ‘পূর্ব ধারণা প্রসূত’, ‘অপ্রাসঙ্গিক’ এবং ‘অপরিপক্বতা’….. সাবেক প্রধান বিচারপতি এ. বি. এম খায়রুল।
সাতজন বিচারপতি নিয়ে গঠিত বেঞ্চের রায় যদি হয় অপরিপক্ব, উদ্দেশ্য প্রণোদিত, ইতিহাস বিকৃত এবং মতলবি তাহলে সার্বজনীন রায় কিভাবে আসতে পারে? রায় কোন পক্ষের বিরুদ্ধে গেলে তারা যদি প্রকাশ্য বিচারপতি তথা আদালতের বিষোদগার করতে পারে তাহলে কি জনমনে আদালতের প্রতি আস্থা থাকবে? এরপরও যদি আদালত অবমাননা না হয় তবে আদালত অবমাননা হয় কি সে? নাকি আদালত অবমাননা প্রীতমের গানের মত, “কৃষ্ণ করলে লীলা খেলা আর আমি করলে…..।