সিলেটের বিভিন্ন হাওরে ‘নাও মেস্তরি’দের ব্যস্ত সময়
প্রকাশিত হয়েছে : ৩১ জুলাই ২০১৭, ৯:১১ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ: ঘর থেকে পা বাড়ালেই পানি। চারপাশ পানিতে থৈ থৈ। দূরে কোথাও যাওয়ার তো সুযোগই নেই। পাড়ার এবাড়ি-ওবাড়ি যেতেও কোমর সমান, গলা সমান পানিতে নামতে হচ্ছে। এ অবস্থায় মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি ও হাকালুকি হাওর পাড়ের গ্রামগুলোয় যাতায়াতের একমাত্র বাহন এখন নৌকা। এভাবে হাওরাঞ্চলে ফিরে আসছে মাঝির গান, বইঠার ছলাৎ ছলাৎ।
বর্ষাকালে সাধারণত এতো পানি হয় না। যারা মাছ ধরেন, গরু-মহিষের জন্য হাওর থেকে ঘাস-দল (শাপলা-শালুক) সংগ্রহ করেন, তারাই কেবল নৌকা নিয়ে পানিতে ভাসতেন। এবার সেই অবস্থা নেই। নিজের থাক বা না থাক, পানিতে ভাসতে নৌকা ছাড়া উপায় নেই। এই অবস্থায় যাদের সামর্থ্য আছে, তারা হাত গুটিয়ে বসে না থেকে নৌকা বানাতে উদ্যোগী হয়েছেন। হাওরাঞ্চলে চলছে এখন নৌকা বানানোর হিড়িক।
‘নাও মেস্তরি’দেরও এখন রমরমা সময়। একটার পর একটা ‘নাও’ তৈরির ফরমাশ আসছে। তারাও হাতুড়ি-বাটাল নিয়ে নেমে পড়ছেন কাজে।
সম্প্রতি মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার রাজনগর-বালাগঞ্জ সড়কের বেশ কয়টি স্থানে দেখা গেল, নৌকা বানানো হচ্ছে। সড়কের মধুরবাজার, রাতিবের দোকানসহ বিভিন্ন স্থানে টুকটাক শব্দের তালে কাঠের টুকরোগুলো নৌকার আদল নিচ্ছে। কাঠের জোড়ায় জোড়ায় চলছে পেরেক ঠোকা।
রাজনগরের পাঁচগাঁও ইউনিয়নের নওয়াগাঁও গ্রামের সজ্জাদ আহমদের সঙ্গে সম্প্রতি কথা হয় রাজনগর-বালাগঞ্জ সড়কের পাঁচগাঁও ইউনিয়নের মধুরবাজারের একটি চায়ের দোকানে। এখানেই তিনি বেশ ক’টি নৌকা বানিয়েছেন।
সজ্জাদ আহমদ বলেন, ‘এবার পানি প্রচুর। ঘর থাকি মানুষ বাইর অইত (হতে) পারে না। এ কারণে মানুষ নৌকাও বেশি বানার (তৈরি করছে)। এ বর্ষাত (বৈশাখ থেকে) এ পর্যন্ত ১০টা নাও বানাইছি। আরও চাইর-পাঁচটার অর্ডার আছে।’
তিনি বলেন, ‘প্রায় ২০ বছর ধরি আমি নৌকা বানাই। এটা আমরার পারিবারিক ঐতিহ্য। বাপ-দাদারাও মেস্তরি (কারিগর) আছলা (ছিলেন)। কইতা পারইন (বলতে পারেন) এটা আমরার মৌসুমি ব্যবসা। শুকনা সময় তো আমরার বেকার যায়।’
সজ্জাদ আহমদ বলেন, বেশ ক-বছর ধরে হাওরে পানি কম হয় বলে মানুষের খুব বেশি নৌকার প্রয়োজন পড়ে না। যে কারণে প্রতিবছর বেশি হলে চার থেকে পাঁচটি নৌকা বানানোর ফরমাশ পান তিনি।
একটা নৌকা বানাতে প্রায় ১২ দিন সময় লাগে। মজুরি নেন ১০ হাজার টাকা। তার সঙ্গে আরো দু’জন সহকারী থাকেন। তিনজনে মিলে নৌকা তৈরি করেন। ১৮ হাত লম্বা একটি নৌকা বানাতে কাঠ, লোহা, আলকাতরাসহ ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়ে থাকে। নওয়াগাঁও গ্রামের বিধুর দাস বলেন, ‘আমি এবার চাইরটা নাও বানাইছি। আমার গেরস্থি (কৃষিক্ষেত) আছে। অবসর সময় নৌকা বানাই।’
পাঁচগাঁও ইউনিয়নের রক্তা গ্রামের এরশাদ মিয়া বলেন, ‘এবার নৌকা বেশি লাগের। পানি বেশি অইছে (হয়েছে)। কোটিপতি-ফকির অউকা (হউক) নৌকা ছাড়া চলতা পারব না। এলাকার ষোলো আনা মাইনষর (মানুষের) মাঝে দুই আনা মাইনষর নৌকা আছে। ১৪ আনা মাইনষরই নাই। যার অবস্থা ভালা, হেই (সেই) নৌকা বানার। আমার ঘরর মধ্যে আটু (হাঁটু) পানি। নৌকা বানাইবার ক্ষমতা নাই। নৌকা ভাড়া নিয়া চলরাম। নাওর মালিকরে মাসে দেড়-দুই হাজার টাকা ভাড়া দেওয়া লাগে।’
পাঁচগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শামসুন নূর আহমদ আজাদ বলেন, কাওয়াদীঘি হাওরে এখনো পানি বাড়ছে। অনেকের নৌকা বানানোর জায়গাও নেই। যারা সুযোগ পাচ্ছেন বানাচ্ছেন। -সুত্র পরিবর্তন