হাওরপারে দুর্দিন
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ মে ২০১৭, ৭:২৫ পূর্বাহ্ণ
আকমল হোসেন, মৌলভীবাজার :
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বরদল সেতুর কাছে দাড়া জাল পেতে মাছ ধরছেন রতন মনি দাস। গত মঙ্গলবার তোলা ছবি l প্রথম আলোমৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বরদল সেতুর কাছে দাড়া জাল পেতে মাছ ধরছেন রতন মনি দাস। গত মঙ্গলবার তোলা ছবি l প্রথম আলো
দুই ছেলেকে সঙ্গে করে মাছ ধরার উদ্দেশ্যে পানিতে নৌকা ভাসিয়েছেন নিপুল দাস (৪৫)। জালে মাছ কেমন ধরা পড়ছে—জানতে চাইলে তাঁর সহজ কথা, ‘মাছ নাই। সারা দিনে ১০০-৮০ টাকার মাছ পাই। বাইচ্চা-কাইচ্চা লইয়া তবু মাছ ধরতে যাইরাম (যাচ্ছি)। মাছ না মারলে বিয়ালেতো (বিকেলে) খরচ খাইবার উপায় নাই। আমরা মাছর ওপর নির্ভরশীল। ভাগিছাগি (বর্গা চাষ) করি ধান করছিলাম। পানিয়ে খাইলিছে।’
গত মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে নিপুল দাসের সঙ্গে কথা হয় মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার হাকালুকি হাওরের ভুকশিমইল ইউনিয়নের বরদল এলাকায়। তাঁর পরিবারে ছয়জন সদস্য। মাছ ধরেই পরিবার চলে। গত এপ্রিল মাসের অকাল বন্যায় হাকালুকি হাওরের তলানো ধান পচে বিষক্রিয়ায় পানিতে অক্সিজেন কমে যায়। এতে প্রচুর মাছ মারা যায়। মৎস্য বিভাগের ধারণা, হাকালুকি হাওরে আনুমানিক ২৫ মেট্রিক টন মাছ মারা গেছে। এই বরদল গ্রামেই প্রায় ৩০০ কার্ডধারী মৎস্যজীবী আছেন। মাছের আকাল হওয়ায় অধিকাংশ মৎস্যজীবীর ঘরেই চলছে অভাব-অনটন।
জেলেপাড়ার ঝরনা রানী দাস (৩৫) বলেন, ‘ধান পানিয়ে নিছে। এখন মাছ মারতে পাইরানা। তিনবারর মাঝে দুইবার খাইতাম পাররাম না। বেটাইনতে (পুরুষ মানুষ) মাছ পাইলেতো জিনিসপত্র আনতা। নুন আনলে মরিচ নাই। অমলান (এ রকম) চলের দিন। মাছ মিলের না দেখিয়া আইজ আমার ছেলে মাছ ধরত যায়নি।’ বরদলে ঝরনা রানী দাসদের পাড়াটি দরিদ্র। অভাব তাঁদের নিত্যসঙ্গী।
তবু মালতি দাস (৩৫) বলেন, ‘আরার (অন্য) বছর অভাব থাকলেও ধান আছিল। মাছও মারতে মিলত। হুরুত্বারে (বাচ্চাদের) পড়াইতাম একটা পয়সাও নাই।’ কমলা রানী দাস (৬০) বলেন, ‘এবারকোর (এ বছরের) মতো অভাব আর অইছে না। আগে খেত নিছেগি, জাল-দড়ি বাইছইন। পাকনা ধান নিছে টানিটুনি অর্ধেক তুলছইন।’
মৎস্যজীবী পরিবারের সন্তান বাবুল দাস এ বছর এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। বাবুল বলে, ‘বাবা গেছইন মাছ ধরতে। কিন্তু মাছ ধরি পেটই দিতা পাররা না। পড়ার খুব ইচ্ছা। কেমনে পড়তাম। কই টাকা পাইতাম।’
বরদল ব্রিজের কাছে দাঁড়া জাল দিয়ে মাছ ধরছিলেন রতন মণি দাস (৪৫)। তিনি বলেন, ‘বড় মাছ নাই। মাছ মরি কমি গেছে। আগে (অন্য বছর এ মৌসুমে) হাজার-পনেরো শ টাকার মাছ পাইছি। এখন ২ কেজি চাউলর দাম পাইরাম। গতকাইল (গত সোমবার) ৫০ টাকার মাছ পাইছলাম। ২ কেজি আটা আনছি। ১০-১২ কিয়ার খেত করছিলাম। সারা পানিয়ে নিছেগি। মাস খানিক আগে ১০ কেজি চাউল পাইছলাম। আর কুনতা পাইছি না।’ সংসারে তাঁর আট সদস্য।
ভুকশিমইল ইউনিয়নের হাওরপাড়ে ইসলামপুর বাজার। জেলেরা মাছ ধরে এনে এখানে বিক্রি করেন। খুচরা মাছ ব্যবসায়ীরা মাছ কিনে আশপাশের বাজারে নিয়ে বেচেন। গত মঙ্গলবার বিকেলে গিয়ে দেখা গেছে, কিছু মাছ ব্যবসায়ী বসে লুডু খেলছেন। ছোট দু-একটা নৌকা এসে ভিড়েছে। তাঁদের কাছে অল্প কিছু পুঁটি, ট্যাংরা, ছোট চাঁদাজাতীয় মাছ। এগুলো নিয়ে অনেকে দরদাম করছেন।
কুলাউড়া উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা মো. সুলতান মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘কুলাউড়া উপজেলায় ১ হাজার ৭০০ নিবন্ধিত জেলে আছেন। জেলেরা মোটামুটি কষ্টের মধ্যে আছেন। মৎস্য অধিদপ্তর থেকে ত্রাণ দেওয়ার সুযোগ নেই। আমরা ত্রাণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছি। তবে এই অবস্থা থাকবে না। মাসখানেক পরে মাছ বাড়বে।’
জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, হাকালুকি হাওর এলাকায় ৪ হাজার জেলে নিবন্ধিত আছেন। হাওরে মাছের ঘাটতি পোষাতে বিল নার্সারির (হাওর এলাকার বিল বা পুকুরে পোনা উৎপাদন) জন্য ২৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। অপরদিকে হাওরে রুই, কাতলা ও মৃগেল জাতীয় পোনা অবমুক্তের জন্য ২৮ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। আগামী ২০ জুনের মধ্যে পোনা হাওরে ছাড়া হবে।
ভুকশিমইল ইউপির চেয়ারম্যান মো. আজিজুর রহমান গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত মৎস্যজীবী হিসেবে আলাদা কোনো ত্রাণ দেওয়া হয়নি। গরিব দেখে সাধারণ ত্রাণ থেকে কিছু কিছু লোককে সাহায্য দেওয়া হয়েছে। শুনছি ত্রাণ আসবে। এখনো আসেনি।’
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুল কুদ্দুস আকন্দ প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাকালুকিতে মাছের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বিল নার্সারি করা হবে ও পোনা ছাড়া হবে। মা মাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মা ও পোনা মাছ যাতে কেউ না ধরে, সে জন্য প্রচারণা চালানো হচ্ছে। তবে পুঁটি, ট্যাংরা, মলাসহ ছোট মাছের পোনা দেখা যাচ্ছে। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে হাওর থেকে মাছ হারিয়ে যায়নি। নির্বংশ হয়নি। আত্মবিশ্বাস ফিরে আসছে। মাছ হারিয়ে যাবে না।’ সূত্রঃ প্রথম আলো