কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতি ও রাজনীতি
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ এপ্রিল ২০১৭, ১১:২২ অপরাহ্ণ
সুহেল আহমেদ চৌধুরীঃ “কওম” গুগল অভিধান অনুসারে যার ইংরেজি অর্থ People । বাংলায় এর অনেক গুলি প্রতিশব্দ রয়েছে যেমন সম্প্রদায়, জাতি, জনতা, অধিবাসীগণ, জনসাধারণ। মূল শব্দ আরবি। কওম থেকে কওমি। কওমি অর্থ হল গোত্রীয়, জাতীয়, জনগণ সম্পর্কিত। শব্দ দু’টি এই অর্থে ফার্সি এবং উর্দু ভাষাতেও ব্যবহৃত হয়। মাদ্রাসাও আরবি শব্দ। এর অর্থ হল অধ্যয়নের স্থান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্কুল। একই অর্থে শব্দটি উর্দু ও ফার্সি ভাষাতেও ব্যবহৃত হয়। সুতরাং ‘কওমি মাদ্রাসা’ এর মানে হল জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা জাতীয় বিদ্যাপীঠ।
#এই মুহূর্তে বাংলাদেশে আলোচিত একটি শব্দ কওমি শিক্ষার স্বীকৃতি। কারণ সরকার কওমি মাদ্রাসা সনদের স্বীকৃতি দিয়েছে । নিঃসন্দেহে এটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। সরকার শুধু ঘোষণা দেয়নি, ইতিমধ্যে প্রজ্ঞাপন জারি করে একটি সংস্থা গঠন করেছে। সেই সংস্থার অধীনে দওরায়ে হাদিস বা তাকমীলের পরীক্ষার তারিখও ঘোষণা করেছে ।
##ঘোষিত তারিখ অনুযায়ী আগামী ১৫ থেকে ২৫মে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কোন ধরণের সিলেবাসের পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন, বিয়োজন ছাড়া এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। আগে কওমি মাদ্রাসায় মারহালাতুল তাকমীল বা দওরায়ে হাদিস শ্রেণীতে যে বিষয় পড়ানো হত এখন তাই হবে। আগে বুখারী ১ম ও ২য় খণ্ড, মুসলিম ১ম ও ২য় খণ্ড, তিরমিযী ১ম ও ২য় খণ্ড, আবু দাউদ, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ, ত্বহাবী, মুআত্তান, কেরাত ইত্যাদি পড়ানো হত।
##পক্ষান্তরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় মাস্টার্স ইসলামিক স্টাডিজের সিলেবাসে হাদিস, তাফসির, ফিকাহ, সুফিজম, মুসলিম দর্শন ও দার্শনিক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে মুসলমানদের অবদান, ইসলামী ব্যাংক ও ইনস্যুরেন্স এবং মুসলমানের ইতিহাস। এক বছরের এই কোর্সে ৪ক্রেডিট করে আট বিষয়ে ৩২ ক্রেডিট সম্পন্ন করতে হয়। বেফাক এর সিলেবাস অনুযায়ী মাধ্যমিক পর্যন্ত ১০০ মার্কের ইংরেজি পড়ানো হয়, উচ্চ মাধ্যমিকে ইংরেজি নেই তবে ৫০ মার্কের বাংলা পড়ানো হয়। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা আরবি, ফার্সি ও উর্দু এই তিনটি ভাষা শিখতে গিয়ে মাতৃভাষাও ভালভাবে শিখতে পারে না। বেসিক ইংলিশ বা গণিতের অবস্থা আরও করুণ। এই অবস্থা বিদ্যমান রেখে কোন সিলেবাস পরিবর্তন না করে কওমি শিক্ষার্থীদের স্নাতকোত্তর মানের সনদ অর্জনের পরীক্ষার রুটিন ঘোষণা নিঃসন্দেহে কওমি শিক্ষার্থীদের প্রতি তামাশা। কাজেই কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতির পক্ষে বিপক্ষে নানা যুক্তি উত্থাপিত হয়েছে। রাজনৈতিক কারণে কওমি মাদ্রাসা সবসময়ই ভোটের রাজনীতির শিকার!
## বিগত সরকারের আমলে ২০০৬ গেজেট হয়েছিল কওমি সনদের স্বীকৃতির জন্য। তখন নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অত্যাসন্ন ছিল। কিন্তু সে সরকার তাদের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ায় করতে পারেনি। ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। তাই কওমির বিপুল সংখ্যক ভোট একটি ফ্যাক্টর, কাজেই ভোটের প্রয়োজনে সরকার ঘোষণা দিয়েছে কওমি সনদের সর্বোচ্চ স্তর প্রচলিত সাধারণ শিক্ষা স্নাতকোত্তর স্তরের সমমান। জেনারেল শিক্ষিতরা প্রচলিত ব্যবস্থায় (5+3+২+২+৪+১) ১৭ বছরের শিক্ষায় যথাক্রমে পিএসসি, জেএসসি, এস.এস.সি, এইচ.এস.সি, অনার্স, মাস্টার্স সহ ছয়টি সনদ অর্জন করেন। কিন্তু সরকার ঘোষিত মর্যাদা অনুসারে কওমি শিক্ষার্থীরা সর্বোচ্চ স্তরে না গেলে কোন সরকারী স্বীকৃতি পাচ্ছে না। এর যুক্তি হিসাবে গঠিত কমিটির সদস্যরা বলছেন আলিয়ার মত শিক্ষার্থীরা যাতে কনভার্ট না হয় এবং পূর্ণাঙ্গ আলেম হওয়ার জন্য তার সবগুলো প্যাকেজ পড়া প্রয়োজন। বিসিএসসহ সকল নিয়োগ আবেদন প্রক্রিয়ায় চারটি সনদের তথ্য চাওয়া হয়। কিভাবে কওমি গ্রাজুয়েটরা সমস্ত সরকারী চাকুরীতে প্রবেশ করবে একটি সনদ দিয়ে? সাধারণ যে কোন চাকুরীর পরীক্ষায় যথাক্রমে বাংলা, ইংরেজি, গণিত এবং সাধারণ জ্ঞান এই চার বিষয়ের পরীক্ষা হয়। এই চার বিষয় থেকে কওমি শিক্ষার্থীরা যোজন যোজন দূরত্বে। কিভাবে তারা এসব পরীক্ষায় ভাল করবে?
তাছাড়া ডিগ্রী প্রদানের জন্য সংস্থা কেন, একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে এর মাধ্যমে এফিলিয়েশন দেওয়া যেত সারা দেশের সকল কওমি মাদ্রাসা সমূহকে। আলিয়া মাদ্রাসার গ্রাজুয়েট যারা ২০০৮ সালের আগে ফাজিল কামিল করেছেন, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে অধীনে তাদের ফাজিল কামিল ডিগ্রী। বোর্ডে অধীনে তাদের ফাজিল কামিল বিধায় তাদের ডিগ্রী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সমমান নয়। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়ার পর যারা উত্তীর্ণ হয়েছেন তারাই কেবল সাধারণ শিক্ষার সমমানের ডিগ্রীধারীর সমমান।
মেডিকেল রিলেটেড চারটি ডিগ্রী আছে চারটি বিভিন্ন সংস্থা প্রদান করে যেমন MCPS = Member of the college of physicians and surgeons, FCPS =Fellow of the college of physicians and surgeons ,
MRCP= Member of the royal college of physicians , FRCS= Fellow of the royal college of surgeons । কিন্তু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত এম.ডি, এম.এস কোর্স এর গুরুত্ব ও মর্যাদা অনেক বেশী। সুতরাং মান দেওয়া হলে তাদের পূর্নাঙ্গ মান দেওয়া প্রয়োজন। কোন সংস্থার অধীনে না দিয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দেওয়া উচিত। কওমি আলেমরা একটি কথা বলেন তারা সরকারের সাহায্য নিলে সরকারের আদেশ মানতে বাধ্য হতে হয়। যে কোন দেশে কোন প্রতিষ্ঠান চালাতে হলে সে দেশের সরকারের সকল আইন মেনে নিয়ে চালাতে হয়।
#পরিসংখ্যান
সারা দেশে ১৩ হাজার ৯০২টি কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি মাদ্রাসা, ৪ হাজার ৫৯৯টি। সবচেয়ে কম বরিশালে, ১ হাজার ৪০টি। বেশির ভাগ মাদ্রাসাই মফস্বল এলাকায় অবস্থিত। তবে ২০০৮ সালের ব্যানবেইসের জরিপ অনুযায়ী, মোট কওমি মাদ্রাসার মধ্যে ১২ হাজার ৬৯৩টি পুরুষ ও ১ হাজার ২০৯টি মহিলা মাদ্রাসা রয়েছে। এসব মাদ্রাসায় ১০ লাখ ৫৮ হাজার ৬৩৬ জন ছাত্র ও তিন লাখ ৩৯ হাজার ৬১৬ জন ছাত্রী পড়াশোনা করছে। সারা দেশে শিক্ষক আছেন ৭৩ হাজার ৭৩১ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৬৬ হাজার ৯০২ জন এবং মহিলা ৬ হাজার ৮২৯ জন।
ব্যানবেইসের তথ্য বলছে, সংখ্যার দিক দিয়ে ঢাকার পরেই চট্টগ্রামে মাদ্রাসা বেশি, ২ হাজার ৯৮৪টি। এর পরে রাজশাহীতে ১ হাজার ৭০২টি, সিলেটে ১ হাজার ২৪৬টি, রংপুরে ১ হাজার ১৭৬টি, খুলনায় ১ হাজার ১৫৫টি।
২০০৮ সাল পর্যন্ত বেফাকে রেজিস্টার্ড মাদ্রাসার সংখ্যা যথাক্রমে তকমিল (মাস্টার্স ডিগ্রী)সমমানের ৩০০ প্রতিষ্ঠান, ফযিলত (স্নাতক) সমমানের ২০০ প্রতিষ্ঠান, সানাবিয়া উলইয়া(উচ্চ মাধ্যমিক) সমমানের প্রতিষ্ঠানের ১০০০ প্রতিষ্ঠান, সানাবিয়া আম্মাহ (মাধ্যমিক) সমমানের ১০০০ প্রতিষ্ঠান, মুতা্ওয়াছসিতাহ (নিম্ন মাধ্যমিক ) ২০০০ প্রতিষ্ঠান এবং এবতেদায়ী (প্রাথমিক) ৩০০০ প্রতিষ্ঠান এবং হিফজুল কুরআন বা কুরআন মুখস্থবিদ্যা ২০০০ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তথ্য সূত্র বেফাক ওয়েব সাইট http://www.wifaqbd.org
এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী কোথায় তাদের অন্নের সংস্থান করবে। তোদের অবশ্য ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি কর্মমুখী ও সাধারণ শিক্ষা দিতে হবে যাতে তারা চলমান প্রতিযোগীতাময় বিশ্বে ঠিকে থাকতে পারে।১৪ লাখ শিক্ষার্থী ভোটের রাজনীতির শিকার হয়ে শুধু তাকমীলের একখান সনদ নিয়ে কি করবে? সংস্থা কর্তৃক প্রদত্ত এই সনদ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পাবে নাকি?
(সুরমানিউজ এর পাঠককলামে প্রকাশিত সব লেখা পাঠক কিংবা লেখকের নিজস্ব মতামত। এই সংক্রান্ত কোনো ধরনের দায় সুরমানিউজ বহন করবে না। সুরমানিউজ এর কোনো লেখা কেউ বিনা অনুমতিতে ব্যবহার করতে পারবেন না।)