ভাতে মারার স্লুইস গেইট অপসারণে বালাগঞ্জ-ওসমানীনগরের কৃষকদের জিহাদ ঘোষনা!
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ এপ্রিল ২০১৭, ৯:৪৯ অপরাহ্ণ
বিশেষ প্রতিনিধি:
অপরিকল্পিত ভাবে নির্মিত একটি স্লুইস গেইটকে বালাগঞ্জ-ওসমানীনগর উপজেলার কৃষকরা ‘ভাতে’ মারার স্লুইস হিসেবে অখ্যায়িত করেছেন। স্লুইস গেইটটি এখন কৃষকদের বিষফোঁড়ায় পরিণত হয়েছে। যে স্লুইস গেইটে পর্যাপ্ত পরিমানে পানি নিষ্কাষন না হওয়ায় তলিয়ে গেছে কয়েকটি হাওরের ফসলি জমি। বছরে এক ফসলা নির্ভরশীল কয়েক সহস্রাধিক কৃষক দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তাদের জীবনে ঘোর অমানিশা দেখা দিয়েছে।
বালাগঞ্জ উপজেলার দেওয়ান বাজার ইউনিয়নের রুগনপুর, মুক্তারপুর গ্রামসহ একাধিক গ্রাম এবং পশ্চিম গৌরীপুর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম, ওসমানীনগর উপজেলার দয়ামীর ইউনিয়নের ঘোষগাঁও, খাগদিওর, খালপার, মিরপাড়া, চিন্তামনি, নিজ কুরুয়া, চন্ডিতিওর, কেশবপুর, সন্নাসীপাড়া, রাধাকোনা, উছমানপুর ইউনিয়নের ইছামতি, মল্লিকপুর, সুলতানপুর গ্রামের কৃষকরা রুনিয়া প্রকাশিত চক রুহিনী হাওর, ছাউনিয়া হাওর ও ডোবার হাওরে উচ্চ ফলনশীল বোরো চাষবাদ করেন। কিন্তু ত্রুটিপূর্ণ একটি স্লুইস গেইটের কারনে কৃত্রিম জলাবদ্ধতায় এসব হাওরগুলোর শতভাগ ফসল এখন পানিতে নিমজ্জিত। স্লুইস গেইটটি অপসারণের দাবিতে বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগরের সংশ্লিষ্ট এলাকার কৃষকরা ফুঁসে উঠে জিহাদ ঘোষনা করেছেন। ৪এপ্রিল বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগর উপজেলার চারটি ইউনিয়নের বাসিন্ধা ও কৃষকদের যৌথ উদ্যোগে ২৩ সদস্যের অন্তর্ভুক্তিতে ‘রুনিয়া ও হাউনিয়া হাওর বোরো ফসল রক্ষা সংগ্রাম কমিটি’ নামে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
স্লুইস গেইট অপসারণের দাবিতে গঠিত কমিটির পক্ষ থেকে ৬এপ্রিল সিলেট এলজিইডি নির্বাহী প্রকৌশলীর নিকট লিখিত আবেদন দেয়া হয়েছে। একই দাবিতে গঠিত কমিটির পক্ষ থেকে ৯ এপ্রিল সাংবাদিক সম্মেলনও করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট হাওরের কৃষক, স্থানীয় এলাকাবাসী, গঠিত কমিটি পক্ষ থেকে দেয়া আবেদন ও সংবাদ সম্মেলনে দেয়া লিখিত বক্তব্য সুত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ১৪ আগষ্ট হাউনিয়া-ছাউনিয়া হাওর ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি লিং এর আওতায় (রেজি নং-বালা-০২.১৩-১৪) ওসমানীনগর উপজেলার উছমানপুর ইউনিয়নের মোমিনপুর গ্রামের ভিতরে জাইকার অর্থায়নে একটি স্লুইস গেইট স্থাপন করা হয়। কিন্তু স্লুইস গেইটটি সংকীর্ণ পরিসরে নির্মান করার ফলে প্রতি বছরই বর্ণিত এলাকার কৃষকদের চাষকৃত উচ্চ ফলনশীল বোরো ফসল ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে।
হাওর ব্যববস্থাপনা সমিতি ও প্রকল্পের লোকজনের সাথে স্লুইস গেইট নির্মানকাল থেকে স্থানীয় লোকজন দফায়-দফায় দেন দরবার করে আসলেও এর কোনো সুরাহা হয়নী বলে অভিযোগ রয়েছে। হাউনিয়া-ছাউনিয়া প্রকল্পের উজানে প্রায় ৩ কিলোমিটার ১০০ ফুট প্রসস্থ বাগাইয়া বলদা খাল, প্রায় ১৫০ ফুট প্রস্থ ১০ কিলোমিটার দৈর্ঘের হাউনিয়া হাওরের বিশাল জলরাশি নিষ্কাষনের জন্য বর্ণিত স্লুইস গেইটে প্রায় ৪ ফুট বাই ৪ ফুট পরিমানের তিনটি গর্ত আকৃতির নালা রাখা হয়েছে। যা উজানের পানি নিষ্কাষনের জন্য খুবই বেমানান ও অপরিকল্পিত বটে। ২৭ মার্চ থেকে সংশ্লিষ্ট উজান এলাকার হাওর গুলোর বোরো জমির ফসল অতি বৃষ্টিতে নিমজ্জিত হয়। এবিষয়ে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকাবাসী হাওর ব্যবস্থাপনা সমিতির লোকজনের সাথে যোগাযোগ করেন। কিন্তু তারা নানা টাল বাহানা করে ¯øুইট গেইট বন্ধ করে রাখেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ২৮ মার্চ থেকে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত স্লুইস গেইটের উজানে থাকা ১-২ ফুট পানি নিষ্কাষনের ব্যবস্থা থাকলে ৯০ ভাগ জমির ফসল বাঁছানো সম্ভব ছিল বলে সংশ্লিষ্ট এলাকার লোকজনের দাবি। এদিকে ২ এপ্রিল স্লুইস গেইটের উজানের বৃহত্তর এলাকার কৃষকদের পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধি দল হাওর ব্যবস্থাপনা সমিতির লোকজনের সাথে দেখা করতে যান। কিন্তু তারা দেখা করেন নি।
স্লুইস গেইট সংলগ্ন এলাকাবাসীর বরাত দিয়ে লিখিত আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে-সংশ্লিষ্ট সমিতির লোকজন বর্ণিত স্লুইস গেইটের কপাট আংশিক বন্ধ করে ¯্রােতের গতি কমিয়ে রাত্রি বেলা বড় ভাগা নদী থেকে উজানে উঠে আসা মাছ শিকার করেছেন। সব মিলিয়ে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট উজান এলাকার ক্ষতিগ্রস্থ ফসলী জমির পরিমার ৫শ হেক্টর। টাকার পরিমানে ফসলের ক্ষতি প্রায় ছয় কোটি। যেখানে ২০১৫-১৬ সালে ছিল প্রায় চার কোটি। প্রসঙ্গত- বৃহত্তর ময়মনসিংহ, সিলেট ও ফরিদপুর এলাকায় ক্ষুদ্রাকার পানি সম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় এবং জাপানী দাতা সংস্থা জাইকার অর্থায়নে প্রায় সাড়ে ৭কোটি টাকার ব্যয়ে ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে সংশ্লিষ্ট এলাকায় দু’টি প্রকল্প চালু করা হয়। আর এই প্রকল্প গুলোর অধিনেই স্লুইস গেইট নির্মান করা হয় এবং হাউনিয়া-ছাউনিয়া হাওর ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি লি: নামে একটি সামতি গঠন করা হয়। এই প্রকল্পের আওতায় অপরিকল্পিত ভাবে খাল খননের ফলে গত বছর দয়ামীর মাদার বাজার সড়কের (ওসমানপুর ইউনিয়ন অফিসের সম্মুখে) এক পাশ ধসে পড়ে যায়। এতে সড়কটিতে প্রায় ছয় মাস যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। তাছাড়া প্রকল্পের অংশীদারিত্ব দেয়ার জন্য সংশিষ্ট এলাকার কৃষকদের কাছ থেকে শেয়ার ক্রয়ের মাধ্যমে কয়েক লক্ষ টাকা লুটপাট করা হয়েছে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে।
হাউনিয়া-ছাউনিয়া হাওর ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি ও উপকারভোগী ওসমানপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ময়নূল আজাদ ফারুক বলেন, প্রকল্প চালু হওয়ার পর কৃষকরা উপকৃত হচ্ছেন। যারা শেয়ার কিনেছেন তারাও উপকৃত হবেন। কৃত্রিম জলাবদ্ধতা কিংবা মানবসৃষ্ট সমস্যার কারনে হাওর গুলো তলিয়ে যাওয়ার বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন, অতি বৃষ্টি ও অকাল বন্যার কারনে প্রকল্প এলাকার প্রায় ৫শ হেক্টর জমির বোরো ফসল তলিয়ে গেছে। ‘রুনিয়া ও হাউনিয়া হাওর বুরো ফসল রক্ষা সংগ্রাম কমিটি’ আহবায়ক আব্দুল হাই মোশাহিদ জানান, ৯ এপ্রিল স্লুইস গেইট অপসারণের দাবিতে এলাবাসীর দেয়া আবেদনের শুনানী হওয়ার কথা ছিল। ঐ দিন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা স্লুইসগেইট সহ সংশ্লিষ্ট এলাকা পরিদর্শন করার কথাও জানিয়েছিলেন। কিন্তু কর্মকর্তারা স্বার্থন্বেষী মহলের কাছে বিক্রি হয়ে গেছেন। তাই শুনানী হয়নি, পরিদর্শনেও কেউ আসেনি। এ বিষয়ে আমরা এখন দুদকের দ্বারস্থ হবো। ‘রুনিয়া ও হাউনিয়া হাওর বুরো ফসল রক্ষা সংগ্রাম কমিটির’ কৃষকরা অভিযোগ করে বলেন, একটি স্লুইস গেইটের কারনে সারা বছর আমাদের ভাতের অভাব করতে হবে।