কলঙ্ক পিছু ছাড়ছেনা সিলেটবাসীর !
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ মার্চ ২০১৭, ৫:৪১ অপরাহ্ণ
নিজস্ব প্রতিবেদক:
২০০৬ সালের ১ মার্চ। সিলেটের দিকে পুরো দেশের চোখ। মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গি শায়খ আবদুর রহমান আছেন সিলেট নগরীর সূর্য দীঘল বাড়ীতে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তার অবস্থান চিহ্নিত করে। ১ মার্চ মধ্যরাতে শুরু হয় অভিযান। স্ত্রী-সন্তানসহ গ্রেফতার হোন আত্মগোপনে থাকা শায়খ আবদুর রহমান। ২০০৭ সালে আবদুর রহমানের ফাঁসি হয়। ২০০৬ থেকে ২০১৭ সাল। ১১ বছর পর আবারো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে সিলেট। ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’র পর এবার ‘আতিয়া মহল’। সেবার যেমন সূর্য দীঘল বাড়ি ঘিরে দেশজুড়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল, এবারও তা। চারদিন ধরে আতিয়া মহলের দিকে দৃষ্টি সারা দেশের। গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ৩টা থেকে সিলেট নগরীর শিববাড়ী পাঠানপাড়ার আতিয়া মহল ঘিরে রাখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আতিয়া মহলের নিচতলায় আস্তানা গেড়েছে জঙ্গিরা এমনটা নিশ্চিত হওয়ার পরই সেটি ঘিরে ফেলা হয়। শুক্রবার থেকে শুরু হয় অভিযান। শনিবার সকালে চূড়ান্ত অভিযান শুরু করেন সেনাবাহিনীর প্যারা-কমান্ডোরা। এ অভিযানে নিহত হয় ৪ জঙ্গি। এর মধ্যে আছেন একজন নারী। চার জঙ্গির লাশ উদ্ধার হলেও এখনও শেষ হয়নি অভিযান। সব জঙ্গি নিহত হলেও ভবনে ব্যাপক বিস্ফোরক মজুদ আছে বলে জানিয়েছেন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা।
১১বছর আগের ‘সূর্য দীঘল’ পরে ‘আতিয়া মহল’ বাড়ি দুটি জঙ্গিদের আস্তানা গাড়া ঘাঁটি হিসেবে দেশ-বিদেশে এখন আলোচিত সমালোচিত। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশে জঙ্গিদের ঘাঁটি হিসেবে উঠে এসেছে সিলেটের নাম। ২০০৬ এর পর ১১ বছরে সিলেটে জঙ্গি তৎপরতা চোখে না পড়লেও এবারের আতিয়া মহলে জঙ্গিদের গাড়া আস্তানা ভয়াবহ। জঙ্গি আস্তানা আতিয়া মহলে আজ পঞ্চম দিনের মতো অভিযান অব্যাহত রেখেছেন সেনাবাহিনীর প্যারা-কমান্ডো টিম। আতিয়া মহলে সব জঙ্গি নিহতের খবরে পুরো সিলেটবাসী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও জানাচ্ছেন চাপা ক্ষোভ। বার বার সিলেটে জঙ্গিরা আবাসস্থল গড়ে তোলায় উদ্বিগ্ন সিলেটবাসী। নগরীর বাসিন্দাদের প্রশ্ন বার বার কেন কলঙ্কিত হচ্ছে সিলেট ? জঙ্গিরা নিজেদের হেড কোয়ার্টার ও অসংখ্য বিস্ফোরক মজুদ রাখার নিরাপদস্থল হিসেবে সিলেটকে বেঁছে নেয়ায় সিলেটের জনমনে বাড়ছে আতংক।
সূর্য দীঘল বাড়ীতে আস্তানা গাড়া একসময়কার মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গি শায়খ আবদুর রহমান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পাননি; আতিয়া মহলে আস্তানা গাড়া জঙ্গিরাও পারেনি বাঁচতে।
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারা দেশে একযোগে বোমা হামলা চালিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব ও শক্তির জানান দিয়েছিল জামাআ’তুল মুজাহিদীন (জেএমবি)। এরপর মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গিদের তালিকায় নাম ওঠে নিষিদ্ধ ওই জঙ্গি সংগঠনের প্রধান শায়খ আবদুর রহমানের। আত্মগোপনে থেকে আবদুর রহমান স্ত্রী-সন্তানসহ ঘাঁটি গাড়েন সিলেট মহানগরীর পূর্ব শাপলাবাগের ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ নামক বাড়িতে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শায়খ রহমানের অবস্থান চিহ্নিত করে। ২০০৬ সালের ১ মার্চ মধ্যরাতে সূর্য দীঘল বাড়ি ঘেরাও করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যরাও আসেন ঘটনাস্থলে। ছয় কক্ষের একতলা সূর্য দীঘল বাড়ির পেছনের দিকে একটি কক্ষে সহযোগী মাজেদুল ইসলাম হৃদয় ও আবদুল আজিজসহ অবস্থান ছিল আবদুর রহমানের। অন্যান্য কক্ষে তার স্ত্রী-সন্তানরা ছিলেন। বাড়ির গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। ভিতরে ছোড়া হয় গ্যাস। পরদিন সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন শায়খ রহমানের স্ত্রী-সন্তানরা। বাড়ির ভিতর বিস্ফোরক রয়েছে বলে নিশ্চিত হন অভিযানকারীরা। তবে বিশেষজ্ঞরা দূর থেকে বিশেষ ধরনের ডিটেক্টর দিয়ে সেগুলো শক্তিশালী বিস্ফোরক নয় বলে নিশ্চিত হন। এরপর শুরু হয় চূড়ান্ত অভিযান। অভিযানকারী বাহিনীর দৃঢ়তায় ভড়কে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন আবদুর রহমান। তাকে গ্রেফতারের পর সূর্য দীঘল বাড়ি থেকে ছোট আকারের একটি বোমা, দুই কেজি অ্যালুমিনিয়াম, কয়েকটি বই, ব্যবহার্য জিনিসপত্র ও পারিবারিক ছবি উদ্ধার করা হয়। ২০০৭ সালে ঝালকাঠিতে দুই বিচারক হত্যা মামলায় ফাঁসি হয় আবদুর রহমানের।
সেই ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’র কথা এক দশক পর স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে ‘আতিয়া মহল’। ২৫ মার্চ থেকে শুরু হওয়া এ অভিযান ২৮ মার্চ পর্যন্ত চলে। এ অভিযানে নিহত হয় ৪ জঙ্গি। এর মধ্যে একজন নারীও রয়েছে। তবে জঙ্গিদের এখন পর্যন্ত পরিচয় নিশ্চিত করা হয়নি।
মূলত এই অভিযানই দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অভিযান। এ অভিযানে অংশ নেন সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা।
সূর্য দীঘল বাড়িতে বিভিন্ন বাহিনীর অভিযানে ৩১ ঘণ্টার মধ্যে তৎকালীন শীর্ষ জঙ্গি শায়খ আবদুর রহমানকে দুই সহযোগীসহ গ্রেফতার করা হয়েছিল। কিন্তু আতিয়া মহলের জঙ্গিবিরোধী অভিযানের আজ পাঁচদিন। সব জঙ্গি নিহত হলেও বাড়িতে প্রচুর পরিমাণে বিস্ফোরক থাকায় পঞ্চম দিনের আতিয়া মহলে অভিযান অব্যাহত আছে। এটাই দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড়, ভয়াবহ ও দীর্ঘ সময় ধরে চলা জঙ্গিবিরোধী অভিযান। এর আগেও জঙ্গি আস্তানায় অভিযান হয়েছে কিন্তু এত সময় কখনও লাগেনি। বিশেষ করে জঙ্গিরা যেভাবে প্রতিরোধ গড়েছিল অন্য কোনো আস্তানায় এভাবে প্রতিরোধও গড়তে পারেনি। এমনকি গুলশানের হলি আর্টিজানে ৬ জঙ্গি ভয়াবহ যে হামলা করেছিল সেটি মুক্ত করতেও ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় নেয়নি সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা।