১১বছর পর আবার শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় সিলেটবাসী
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ মার্চ ২০১৭, ২:২৬ পূর্বাহ্ণ
নিজস্ব প্রতিবেদক:
পুরো দেশসহ সিলেটের লাখো প্রবাসীদের ভাবনায় এখন সিলেটের জঙ্গি আস্তানা। কি হবে ? শেষ পর্যন্ত অভিযান কি সফল হবে ? আত্মসমর্পণ করবে কি জঙ্গিরা ? এসব প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে সচেতন মহলসহ সবার মনে। উৎকন্ঠায় আর শংকায় আরও একটি শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানের মুখে সিলেটবাসী। ২০০৬ থেকে ২০১৭ সাল। দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গি হামলা হলেও এই ১১ বছরে সিলেটে তেমন জঙ্গি তৎপরতা চোখে পড়েনি। জেএমবি প্রধান শায়খ আবদুর রহমানকে টিলাগড়ের শাপলাবাগের সূর্যদীঘল বাড়ি থেকে গ্রেফতারের পর সিলেটে এটি দ্বিতীয় অভিযান। এবার জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে অভিযান চালানো হয় দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি ‘আতিয়া মহল’ নামক একটি বাড়িতে। সূর্যদীঘল বাড়ি অপারেশনের সময় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নেওয়া হয়েছিল নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আতঙ্কে ছিলেন পুরো এলাকার লোকজন। এখন আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন একটি ভবনের ২৯টি পরিবারের সদস্যরা।
শিববাড়ির পাঠানপাড়ায় পাঁচতলা ভবন আতিয়া মহলের নিচতলার একটি ফ্ল্যাটে ‘জঙ্গিরা’ অবস্থান করছে_ এমন সন্দেহে বাড়িটি ঘিরে রাখে পুলিশ। ওই বাড়িসহ এলাকার বিদ্যুৎ সংযোগও বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। ফলে ভবনের ৩০টির মধ্যে ২৯টি ফ্ল্যাটে থাকা পরিবারের বাসিন্দারা রয়েছেন চরম আতঙ্কে মধ্যে। শিশু-নারীসহ আটকা পড়া বাসিন্দারা মোবাইল ফোনে তাদের উৎকণ্ঠিত স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। ইতিমধ্যে সোয়াট সদস্যরা ঘটনাস্থলে পেঁৗছে অভিযানের অপেক্ষায় রয়েছেন। সন্ধ্যায় সেনাবাহিনীর একটি টিম ঘটনাস্থলে এসে পৌছায়। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের আরামবাগের এক আস্তানা থেকে গ্রেফতার দুই জঙ্গির তথ্যের ভিত্তিতেই সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার শিববাড়ির জঙ্গি আস্তানার খবর পান গোয়েন্দারা। পরে প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা তথ্যের সাহায্যে বাড়িটি চিহ্নিত করা হয়। ঢাকার কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্যরা (সিটিটিসি) এই জঙ্গি আস্তানার বিষয়টি সিলেটের পুলিশকে অবহিত করে। সিটিটিসির ডিসি মহিবুল ইসলাম খান সাংবাদিকদের এমন তথ্য জানান। সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এসএম রোকন উদ্দিন বলেন, আমরা প্রযুক্তির মাধ্যমেই নিশ্চিত হয়েছি। এখন অভিযানের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
সকাল ৮টার দিকে আতিয়া মহল নামে পাঁচতলা ভবনের নিচতলার একটি ফ্ল্যাট থেকে গুলি ছোড়া হয়। পুলিশও পাল্টা গুলি ছোড়ে। বার বার আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হলেও কোনো সাড়া দেয়নি জঙ্গিরা।
একইভাবে ২০০৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি গোয়েন্দারা খবর পান নগরীর টিলাগড় সূর্যদীঘল বাড়ি নামে একটি ভবনে শায়খ আবদুর রহমান ও তার সঙ্গীরা লুকিয়ে আছে। জঙ্গিনেতা শায়খ আবদুর রহমানকে জীবিত গ্রেফতার করে অভিযান সফল করতে প্রায় দু’দিন লেগে যায়। রীতিমতো শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এই সময় কাটে। র্যাবের কমান্ডো দল দফায় দফায় বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। ২৭ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টায় সূর্যদীঘল বাড়ি ঘিরে অভিযান শুরু হয়। শায়খের সঙ্গে ওই বাড়িটিতে মোট ১২ জন ছিল। পরের দিন সকালে গ্যাস প্রয়োগ করার পর বাড়ির ভেতরে শিশুদের কান্নার শব্দ শোনা যায়। প্রাণহানি রুখতে কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হয়। বাড়ির গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর নারী ও শিশুরা বেরিয়ে আসে।
এর আগে বাড়ির দেয়াল ও ছাদ ফুটো করে ভেতরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হয়। ভেতরের চারটি ঘরে কাউকে দেখা যায়নি। এরপর ওই বাড়ির দেয়ালের ফুটো দিয়ে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যরা ভিডিও ছবি তুলতে হান্টার লুকিং ডিভাইস ব্যবহার করেন। রাতেই অনুমান করা হয়, তেমন বিধ্বংসী কিছু বাড়িতে নেই। শায়খ রহমানের কাছে বোমা ছিল। যাতে সে আত্মঘাতী কিছু না করতে পারে, সেজন্য তার ওপর বল প্রয়োগ না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অভিযান চলার সময় যাতে শায়খকে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে না হয়, সেজন্য বারবার তাকে বাইরে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়। সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ২ মার্চ সকাল সোয়া ৭টায় দেশের মোস্ট ওয়ানটেড শীর্ষ জঙ্গিনেতা শায়খ আবদুর রহমান সূর্যদীঘল বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। এভাবেই অবসান ঘটে দু’দিনের শ্বাসরুদ্ধকর রক্তপাতহীন অভিযানের। ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ জেএমবি প্রধান শায়খ আবদুর রহমানের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। কিন্তু এখনও তাকে সিলেটে কারা এনেছিল, কার মাধ্যমে শায়খ রহমান সূর্যদীঘল বাড়িতে অবস্থান নিয়েছিল, সেটি রয়েছে অজানা।
যে পরিচয়ে বাসা ভাড়া নেয় জঙ্গিরা : গত জানুয়ারির শুরুর দিকে প্রায় ৩০ বছর বয়সী কাওছার নিজেকে একটি বাণিজ্যিক কোম্পানির কর্মকর্তা পরিচয়ে ওই বাসা ভাড়া নেন। সঙ্গে ছিলেন মর্জিনা। আতিয়া মহলের মালিক উস্তার আলী বলেন, ‘তারা নিজেদের স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দেন। এত দিন তাদের কর্মকাণ্ডে সন্দেহজনক কিছু দেখা যায়নি। তবে পুলিশের কাছ থেকে তাদের জঙ্গি পরিচয় জানার পর সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছি। ’
দফায় দফায় গুলির শব্দ : সিলেটের জঙ্গি ঘাঁটি ঘিরে গতকাল সকাল থেকে পুলিশ, র্যাব, ডিবি, এসবি, পিবিআইসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবস্থান নেয়। রাতে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত দফায় দফায় শোনা যায় গুলির শব্দ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জঙ্গিদের ব্যতিব্যস্ত ও আতঙ্কে রাখতে ফাঁকা গুলি ছোড়ে।