হেলপার থেকে নেতা : সিলেট পরিবহন বিভাগে আতঙ্কের এক নাম আবু সরকার
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ৮:২৩ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ:
সখ্যতা ভেঙ্গে যাবে এভাবে ভাবেননি রাধিকা রঞ্জন দাস। এক সময় ছিলেন তরকারি বিক্রেতা। এখন শ্রমিক নেতা। পরিবহন বিভাগে নৈরাজ্যের অন্তম কারিগর। রাস্তায় চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী, দালালী করে আসছেন সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার সুখাইড় গ্রামের রাধিকা রঞ্জন দাস ওরফে আবু সরকার। জীবিকার সন্ধানে সিলেট আসেন নব্বই দশকে। ট্রাকচালক আবদুল মতিনের হাত ধরে হেলপার হিসাবে কাজ শুরু করেন (সিলেট-ট-০২-০০১১ )। রাধিকা রঞ্জন-জটিল এ নাম পছন্দ হয়নি আবদুল মতিনের। আদর করে নাম দেন আবু। দ্রুতই সবকিছু শিখে নেন আবু। এ কারণে আবদুল মতিনও স্নেহ করতেন তাকে। তবে সে স্নেহের মূল্য দেননি আবু। ট্রাকের মালিককে ভুল বুঝিয়ে আবদুল মতিনকে সরিয়ে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নেন নিজের হাতে। ওস্তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলেও তার দেয়া নামটা আর পাল্টাননি। তবে পাল্টে ফেলেন পদবি। নতুন পরিচয়ে তিনি এখন আবু সরকার। তবে রহস্য ধরে রেখেছেন এ নামেও। পুরো খোলাসা করতে চান না নিজের পরিচয়। কখনো সামনে আসেন শ্রী আবু সরকার নামে কখনো বা মো. আবু সরকার। আবু সরকার-সিলেট জেলা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি। প্রশাসন, রাজনীতিবিদ সবার সঙ্গে তার গভীর সখ্য। কথায় কথায় অচল করে দিতে পারেন সিলেটের সব গাড়ির চাকা। ট্রাক শ্রমিক নেতা হলেও আবু সরকার খাতির করেন না ট্রাক শ্রমিকদেরও। নিজের স্বার্থটাই তার কাছে সবার আগে। তার দাপটে অসহায় হলেও মুখ খুলতে সাহস পান না ট্রাক শ্রমিকরা। কিংবা মুখ খুলেও প্রতিকার মেলে না। তহবিল সংগ্রহের নামে পথে পথে ট্রাক থেকে চাঁদা তোলা হয়। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ কমিশনারের কাছে স্মারকলিপি দিয়েও কাজ হয়নি। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের চণ্ডিপুলসহ ৬ পয়েন্টে চাঁদা তোলার প্রতিবাদে গত ৮ই এপ্রিল ১৩০ ট্রাক শ্রমিক এ স্মারকলিপি দেন। আবু সরকারের প্রভাবের কাছে হার হয়েছে তাদের। প্রতিকার পাননি ট্রাক শ্রমিকরা। লাল পতাকা টাঙিয়ে এখনও চলছে চাঁদাবাজি। ভাগ-বাটোয়ারা শেষেও প্রতিদিন লাখ টাকা ঢুকছে আবু সরকারের পকেটে। সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক এডভোকেট রণজিৎ সরকারের মামা-এ পরিচয় আবু সরকারের অন্যতম এক পুঁজি। এ পুঁজির বলে যেখানে তার থাকার কথা নয় সেখানেও মাথা গলান আবু সরকার। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে অগ্নিসংযোগের দিনে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের সশস্ত্র মিছিলে ছিলেন আবু সরকারও। অগ্নিসংযোগের মামলায় অভিযুক্তও হয়েছিলেন। ছবি ও ভিডিও ফুটেজ দেখে সন্দিগ্ধ হিসেবে সিআইডি তাকে শনাক্তও করে। কিন্তু ‘প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী’ না পাওয়ার দোহাই দিয়ে আপাত রেহাই পান। পরবর্তীতেও যাতে বেঁচে যেতে পারেন আবু সরকার সে ফাঁকও রেখেছে পুলিশ। চার্জশিটে আবু সরকারের পিতার নাম লেখা হয়েছে রবি। অথচ অনুসন্ধানে জানা গেছে, তার পিতার প্রকৃত নাম রমাকান্ত দাস। ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের ভোটার তালিকায়ও (১৯৯৯-২০০০) বাবার নাম হিসেবে এ নামই উল্লেখ ছিল। সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার সুখাইড় রাজাপুর উত্তর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ঈমান আলীও নিশ্চিত করেন-রমাকান্ত দাসই আবু সরকারের বাবার নাম। যদিও ২০১০ সালের ভোটার তালিকায় আবু সরকারের বাবার নাম রমাকান্ত সরকার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে প্রথম যখন সিলেট এসেছিলেন পিতার নাম ঠিকই লিখতেন-রমাকান্ত দাস। আবু সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে ভারতে জ্বালানি তেল পাচারেরও। বাংলাদেশের চেয়ে ভারতে জ্বালানি তেলের দাম বেশি হওয়ায় একটি সংঘবদ্ধ চক্র দীর্ঘদিন ধরে সিলেটের জাফলং সীমান্ত দিয়ে ভারতে তেল পাচার করে আসছে। গত ১৯শে মার্চ রাতে দক্ষিণ সুরমায় এমনই সন্দেহে তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মনোগ্রামবিহীন একটি ট্যাংক লরি (ঢাকা ড-৩১৪৪) আটক করেন সিলেট জেলা ট্যাংক লরি শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্যরা। লরিটি ৬ লাখ টাকা মূল্যের ডিজেল নিয়ে নারায়ণগঞ্জ থেকে সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকা জাফলং যাচ্ছিলো। এর পরপরই লরিটি ছাড়িয়ে নিতে তৎপর হন ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আবু সরকার। তার তৎপরতায় ট্যাংক লরি শ্রমিক ইউনিয়নের লিখিত অভিযোগ সত্ত্বেও লরিটি ছেড়ে দেয় দক্ষিণ সুরমা থানা পুলিশ। পুলিশের সঙ্গে আবু সরকারের সখ্যের অভিযোগ রয়েছে আরো। পুলিশ ও আবু সরকারের মিতালিতে লাভবান হচ্ছে দু’ পক্ষই। দুই পক্ষের যোগসাজশে যখন তখন ধর্মঘট ডেকে বসেন আবু সরকার। অবরোধ করেন সড়ক-মহাসড়ক। আবু সরকারের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্কের সুতো হয়ে আছেন ট্রাফিকের প্রসিকিউশন শাখার দায়িত্বে থাকা সার্জেন্ট মো. হাবিবুর রহমান। হাবিব-আবু যৌথ প্রযোজনায় নিয়মিতই একটি নাটক মঞ্চায়িত হয় সিলেটের বিভিন্ন পয়েন্টে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিভিন্ন সময়ে নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে ইচ্ছাকৃতভাবেই ট্রাফিক সদস্যদের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন ট্রাক শ্রমিকরা। ট্রাক শ্রমিকরাই ঝামেলার মূল হলেও তারাই ডেকে বসেন অবরোধ। খবর পৌঁছে সার্জেন্ট হাবিবের কানে। তিনি নীরবে অপেক্ষা করেন আরো জটিল পরিস্থিতির। পরিস্থিতি জটিল হলে ঘটনাস্থলে পৌঁছেন। ঝামেলা সৃষ্টির অভিযোগে সাসপেন্ড হন দায়িত্বরত ট্রাফিক সদস্য। সার্জেন্ট হাবিবও চান এটাই। এতে তার বাণিজ্যের পথ প্রসারিত হয়। আর এ সহায়তার বিনিময়ে সার্জেন্ট হাবিব আবু সরকারকে নগরজুড়ে নির্বিঘ্নে দাপট দেখানোর অবারিত পথ খুলে দেয়ার বন্দোবস্ত করে দেন। আবু সরকার চাঁদা সংগ্রহের বিষয়টি করে বলেন, মাল ওঠানামা করানোর স্থলে নির্ধারিত চাঁদা সংগ্রহের সুবিধা না থাকায় পথে চাঁদা তুলতে হয়। তবে অতিরিক্ত চাঁদা আদায়ের বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন। অস্বীকার করেন, এমসি কলেজে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় তার সম্পৃক্ততার কথাও। তিনি বলেন, এমসি কলেজের পাশেই তার বালু-পাথরের ব্যবসা রয়েছে। সংঘর্ষ শুরু হলে তিনি পুলিশকে খবর দেন এবং পরে ঘটনাস্থলে যান। ভারতে তেল পাচারে তার কোন সংশ্লিষ্টতা নেই বলে দাবি করেন আবু সরকার। আওয়ামী লীগ নেতা রণজিৎ সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রণজিৎ সরকার তার ফুপাতো বোনের ছেলে। তবে এ পরিচয়ে প্রভাব খাটানোর বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি। রাধিকারঞ্জন দাস থেকে তার নাম আবু সরকার কি করে হলো এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন এটিও তার বাবার দেয়া নাম। জানান, তার আরো একটি নাম আছে-শম্ভু সরকার। বাবার নাম বলেন রবি সরকার। বাবার নাম হিসেবে রমাকান্ত দাস নামটি স্মরণ করিয়ে দিলে নিরুত্তর থাকেন তিনি।