সিলেটে মৃত্যুকূপ পাথররাজ্য ‘শারপিন টিলা’ ৬ লাশের সন্ধানে পুলিশ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ জানুয়ারি ২০১৭, ৪:৫৩ পূর্বাহ্ণ
ওয়েছ খছরু:
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের শারপিন টিলা। পাথরের সাম্রাজ্য বলে খ্যাত ওই টিলা। প্রতিদিন ওই টিলা থেকে কোটি টাকার পাথর উত্তোলন হচ্ছে। শ্রমিকরা ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে পাথর উত্তোলন করতে গিয়ে লাশ হচ্ছে। গতকাল সকালে ওই টিলায় ঘটেছে মর্মান্তিক ঘটনা। মৃতের সংখ্যা নিয়ে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান মিলেনি। গতকাল সন্ধ্যায় কোম্পানীগঞ্জের স্থানীয় ইউনিয়ন চেয়ারম্যান শাহ জামাল জানিয়েছেন- পাথর উত্তোলনের সময় গর্তে মাটিচাপায় মারা গেছে ৬ জন। তাদের লাশ গর্তের মালিক আনজু মিয়া সরিয়ে নিয়েছেন। একই কথা বলেছেন- কোম্পানীগঞ্জ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আপ্তাব আলী কালা মিয়াও। তিনি বলেন- ৬ জনের লাশ স্থানীয়রা গর্ত থেকে উদ্ধার করেছে। তবে- সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুজ্ঞান চাকমা জানিয়েছেন- বিকাল পর্যন্ত তারা ২ জনের মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন। তবে পুলিশও শুনেছে- ৬ জন নিহত হওয়ার কথা। এ কারণে সিলেটের এডিশনাল ডিআইজির নেতৃত্বে লাশ উদ্ধারে অভিযান চলছে বলে জানান তিনি। স্থানীয়রা জানান-শারপিন টিলার একাংশের নাম মতিয়া টিলা। ওই টিলা বিরোধপূর্ন। একপাশে পাহাড়ি বাইরং নদী ও অপর অংশ ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়। একেবারেই দুর্গম এলাকা। কিন্তু পাথরের সাম্রাজ্য। শারপিন টিলায় গতকাল ভোর থেকে কাজে নামে শ্রমিকরা। সকাল ৭টার দিকে স্থানীয় আনজু মিয়ার গর্তে পাথর উত্তোলন করছিল ১৫ জন শ্রমিক। প্রায় ৩০ ফুট নিচে পাথর উত্তোলনের সময় উপরের অংশ ধসে পড়ে শ্রমিকদের উপর। এতে পাথরের নিচে চাপা পড়েন শ্রমিকরা। উদ্ধারকারী শ্রমিকরা জানান, তারা গর্তের নিচ থেকে ১৫ জনের মতো শ্রমিককে উদ্ধার করেন। এর মধ্যে চারজন ঘটনাস্থলেই মারা যান। আর অপর দুই জন মারা যায় পরে। সব মিলিয়ে ৬ জন মারা যায়। এ ঘটনায় গুরুতর আহত ৬ শ্রমিককে প্রথমে কোম্পানীগঞ্জ এবং পরে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এদিকে, ঘটনার পরপরই গর্তের মালিক আনজু মিয়া আহতদের হাসপাতালে ভর্তি করলেও তিনি নিহত ৬ জনের লাশ সরিয়ে ফেলেন। দুপুরের দিকে কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি বায়েস আলম সাংবাদিকদের কাছে এক জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন। তবে- বিকেলের দিকে পশ্চিম ইসলাম পুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহ জামাল জানান-৬ জনের লাশ গর্তের মালিক আনজু মিয়া তার বাড়িতে নিয়ে গেছেন। পরে লাশগুলো কোথায় নিয়ে যাওয়া হয় সে ব্যাপারে তিনি জানেন না। কোম্পানীগঞ্জ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আপ্তাব আলী কালা মিয়া জানিয়েছেন- গর্তে যারা পাথর চাপায় মারা যায় তাদের পরিবারকে টাকা দিয়ে লাশ গুম করা হয়। এ কারণে নিহতের পরিচয় জানা যায় নি। ঘটনাটি মর্মান্তিক বলে দাবি করেন তিনি। লাশের কোনো সঠিক পরিসংখ্যান না জানায় গতকাল বিকালে সিলেটের অতিরিক্ত ডিআইজির নেতৃত্বে গোটা শারপিন এলাকায় অভিযান শুরু করে পুলিশ। বিকাল পর্যন্ত পুলিশ কোনো লাশ পায়নি বলে বলে জানান এডিশনাল এসপি সুজ্ঞান চাকমা। ইতিমধ্যে মারা যাওয়া দুই জনের পরিচয় পুলিশ জেনেছে। এর মধ্যে একজন হচ্ছে- নেত্রকোনার আল-হাদী ও কাদির। ঘটনাকালীন কোয়ারি এলাকায় থাকা শ্রমিকরাও ৬ জনের মৃত্যুর খবর পুলিশকে অবগত করেছেন বলে দাবি করেন এডিশনাল এসপি। কোম্পানীগঞ্জের শারপিন টিলায় যারা পাথর শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন তারা নিতান্তই খেটে খাওয়া মানুষ। চলতি মৌসুমে এই টিলায় পাথর উত্তোলন করতে গিয়ে কমপক্ষে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু কোনো মৃত্যুর কথা জানে না পুলিশ। ঘটনার পরপরই নিরীহ শ্রমিক পরিবারকে টাকা দিয়ে গোপনে লাশ পাঠিয়ে দেয়া হয় শ্রমিকের গ্রামের বাড়িতে। কখনো কখনো ওই শ্রমিকদের কবর দেয়া হয় শারপিন টিলার আশপাশেই। এই টিলা সীমান্তঘেঁষা। প্রায় ১০০ একর জমিতে টিলা ও তার পাদদেশ। পাথরখনি বলে এই টিলা। কয়েক বছর আগে এই টিলার পাথর সরকার কর্তৃক লিজ প্রদানের মাধ্যমে উত্তোলন করা হলেও এখন কারও লিজে নেই। এই টিলা থেকে প্রতিদিন কোটি টাকার পাথর লুটপাট করা হচ্ছে। আর এই পাথর লুটপাট সিন্ডিকেটে রয়েছে মোহাম্মদ, আনজু, আনই, আইয়ূব আলী ও বশর মিয়া। তারা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে এই টিলার পাথর লুটপাট করছে। প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার ট্রাক্টর দিয়ে উত্তোলিত পাথর নিয়ে আসা হয় ভোলাগঞ্জ এলাকায়। আর আসার পথে স্থানীয়রাই গাড়ি প্রতি ৩০০ টাকা হারে চাদা আদায় করে। এছাড়া নোয়াগাঁও, টিকাডর ও জালিয়ারপাড় এলাকায় তিনটি মসজিদের নামে আরো ৩০০ টাকা আদায় করা হয়। সূত্রঃ মানবজমিন