বঙ্গবীর ওসমানীর নাম মুছে ফেলার সিদ্ধান্ত !
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ জানুয়ারি ২০১৭, ৪:৪৩ অপরাহ্ণ
লন্ডন অফিসঃ
শিক্ষার্থী, অভিভাবক কিংবা স্থানীয় বাসিন্দাদের কোনো ধরণের মতামতের তোয়াক্কা না করেই ওসমানী প্রাইমারি স্কুলের নাম বদলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্কুলটির গভর্নিং বডি। অনেকটা গোপনীয়তার মাধ্যমে নেয়া সিদ্ধান্তে তারা স্কুলটির নতুন নামকরণ করেছে ভ্যালেন্স প্রাইমারি স্কুল। আগামী সেপ্টেম্বর থেকে নতুন নামকরণটি কার্যকর হবে বলে জানা গেছে।
এদিকে ওসমানী প্রাইমারি স্কুল থেকে ওসমানীর নামটি বাদ দেয়ার সিদ্ধান্তের বিষয়টি সম্প্রতি জানাজানি হওয়ার পর বাংলাদেশি কমিউনিটিতে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন সংগঠন ইতিমধ্যে এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে সভা করার পাশাপাশি নানা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। কোনো ধরণের মতামত যাচাই ছাড়া একতরফাভাবে ওসমানীর নাম মুছে দেয়ার সিদ্ধান্তকে স্থানীয় বাংলাদেশিদের ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রতি অবজ্ঞার প্রকাশ হিসেবেই দেখছেন কমিউনিটি নেতৃবৃন্দ। তাঁরা বলছেন, ওসমানী, কাজী নজরুল, শাপলাসহ আরও যে কটি বাংলা নামের প্রতিষ্ঠান টাওয়ার হ্যামলেটসে রয়েছে- সেগুলো ব্রিটেনে বাংলাদেশি কমিউনিটির বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামের স্মারক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। এ নাম বদলে দেয়া ব্রিটেনে বাংলাদেশিদের ইতিহাসকে মুছে দেয়ার সামিল মন্তব্য করেছেন প্রতিবাদীরা। টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের মেয়র জন বিগসও এক বিবৃতিতে বলেছেন, নাম পরিবর্তনের বিষয়ে তাঁর কাছে কোনো পরামর্শ চাওয়া হয়নি। তিনি নাম পরিবর্তনের বিষয়টিকে সমর্থন করেন না জানিয়ে গভর্ণিং বডির প্রতি সিদ্ধান্ত বাতিলের আহবান জানিয়েছেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি ছিলেন জেনারেল এম এ জি ওসমানী। সিলেটের কৃতিসন্তান ওসমানী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ আর্মির হয়ে লড়াই করেন। স্কুলের ওয়েবসাইটেই বলা আছে, এম এ জি ওসমানী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিয়ানমার সেক্টরে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করেন। ১৯৮৪ সালে জেনারেল ওসামনী লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং ব্রিটিশ আর্মির হয়ে এম এ জি ওসমানীর অবদানকে স্বরণীয় করে রাখতে ১৯৮৬ সালে পূর্ব লন্ডনের ভ্যালেন্স রোডে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটির নাম ওসমানী প্রাইমারী স্কুল করা হয়। স্কুলের নাম পরিবর্তনে সংশ্লিষ্ট কারো মতামত নেয়া হয়নি। আবার নাম পরবর্তনের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো চিঠিও ইস্যু করেনি স্কুল কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি অভিভাবকদের কাছে পাঠানো অফস্টেড পরিদর্শন সংক্রান্ত এক চিঠিতে প্রসঙ্গক্রমে স্কুলের নাম পরিবর্তনের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। কবে, কখন, কী কারণে এবং কোন প্রক্রিয়ায় নামটি পরিবর্তন করা হলো সেসবের কোনো ব্যাখ্যা না দিয়েই কেবল বলা হয় যে, আসছে সেপ্টম্বর থেকে স্কুলটির নাম ভ্যালেন্স প্রাইমারি স্কুল হবে।
এরপর বিষয়টি নিয়ে কমিউনিটিতে প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে স্কুলের গভর্নর বডির চেয়ার মার্ক টায়লারের দেয়া একটি বিবৃতি প্রকাশ করে কাউন্সিল। ওই বিবৃতিতে বলা হয়, টাওয়ার হ্যামলেটস এলাকার জনবসতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলাদেশি কমিউনিটি ছাড়াও অন্যান্য কমিউনিটির শিক্ষার্থীদের স্কুলের প্রতি আকৃষ্ট করে একটি বহুসংস্কৃতিক স্কুল হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে স্কুলের নাম পরিবর্তন করেছে গভর্নিং বডি। যে রাস্তায় স্কুলটি অবস্থিত (ভ্যালেন্স রোড) সেই রাস্তার নামে স্কুলের নতুন নামকরণকে একটি নিরপেক্ষ নাম হিসেবে উল্লেখ করা হয় বিবৃতিতে। বিবৃতিতে আরও বলা হয় যে, নাম পরিবর্তনের বিষয়ে আগে কারও সাথে পরামর্শ করেনি গভর্নিং বডি। সিদ্ধান্ত নেয়ার পর বিষয়টি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জানানো হয়।
বিষয়টি নিয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের মতামত জানতে গত সোমবার (১৬ জানুয়ারি) পত্রিকার পক্ষ থেকে টেলিফোন করা হলে প্রধান শিক্ষককে পাওয়া যায়নি। স্কুল থেকে কাউন্সিলের সাথে যোগাযোগের পরামর্শ দেয়া হয়। কাউন্সিলের কাছে প্রশ্ন ছিল, ওসামানী নামের কারণে কোনো অভিযোগ উঠেছে কিংবা কোনো অভিভাবক তাঁর সন্তানকে ভর্তি করাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে কি-না? ব্রিটেনের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেখানে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে চলছে, সেখানে ওসমানী নামটি বহুসংস্কৃতির জন্য বাধা হিসেবে বিবেচনার কী কারণ থাকতে পারে? নাম পরিবর্তনের ভাবনাটি কেন আসলো, এ ক্ষেত্রে কাউন্সিলের ভূমিকাই বা কী ছিল?
এসবের জবাবে কাউন্সিল থেকে ফিরতি ইমেইলে বলা হয়, নাম পরিবর্তনের বিষয়ে কাউন্সিলের কোনো ভূমিকা ছিল না। স্কুল নিজ থেকেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বরং টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের মেয়র জন বিগস নাম পরিবর্তনের বিষয়টিকে সমর্থন করছেন না।
প্রতিবাদ সভা:
এদিকে নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে গত ১৪ জানুয়ারি এক সভা করেছে ‘ভয়েজ ফর জাস্টিস নামে বাংলাদেশিদের একটি সংগঠন। পূর্ব লন্ডনের একটি হলে অনুষ্ঠিত ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রবীণ কমিউনিটি নেতা জিল্লুল হক। কমিউনিটি নেতা কে এম আবু তাহের চৌধুরীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সভায় স্কুল গভর্নিং বডির সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে সভায় বক্তব্য রাখেন সাবেক কাউন্সিলার আব্দুল আজিজ সরদার, কাউন্সিলার ওহিদ আহমদ, সাবেক কাউন্সিলার আব্দুল মতিন, কাউন্সিলার সুলুক আহমদ, কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব লোকমান উদ্দিন, কমিউনিটি নেতা সিরাজুল হক সিরাজ, কলা মিয়া, কমিউনিটি নেতা মোহাম্মদ ইসবাহ উদ্দিন, মাওলানা রফিক আহমদ রফিক, কবি শিহাবুজ্জামান কামাল, শিক্ষক সিরাজুল বাসিত চৌধুরি, নুর বখস, সুহেল আহমদ বদরুল, মোঃ ফয়েজুর রহমান চৌধুরী, শাহাব উদ্দিন, সৈয়দ আহরাজ আহমদ প্রমুখ। বক্তারা বলেন, জেনারেল ওসমানী শুধু বাংলাদেশিদের গর্বের প্রতীক নন, তিনি ব্রিটিশদের জন্য গর্বের প্রতীক। তিনি ব্রিটিশ আর্মির একজন কনিষ্ঠ অফিসার ছিলেন। তিনি ব্রিটিশের পক্ষে লড়েছেন। বক্তারা স্কুলের নাম পরিবর্তনকে বাঙালি কমিউনিটির বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র বলে মনে করেন। তাঁরা বলেন, ওসমানীর নাম মুছে দেয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে আগামীতে বঙ্গবন্ধু, শাপলা ও কবি নজরুল প্রাইমারী স্কুলের নাম পরিবর্তনেরও চেষ্টা চালাবে দুষ্টচক্র।
সভা থেকে ১৯ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার অভিভাবক ও স্থানীয় কমিউনিটি নেতৃবৃন্দকে নিয়ে একটি সভা এবং শুক্রবার জুমার নামাজের পর স্কুলের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এসব কর্মসূচিতে কমিউনিটির সবাইকে এগিয়ে আসার আহবান জানানো হয়।
সিদ্ধান্ত বাতিলের আহবান মেয়রের:
ওসমানী স্কুলের নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র জন বিগস। স্কুলের নাম পরিবর্তনের কথা শুনে তিনি আহত হয়েছেন জানিয়ে বলেন, নিজের এই উদ্বেগের কথা তিনি স্কুলের গভর্ণিং বডির কাছে তুলে ধরবেন। একইসাথে বাংলাদেশী কমিউনিটির কাছে ওসমানী নামের যে একটি প্রতিকী গুরুত্ব রয়েছে তা তুলে ধরবেন বলে জানান তিনি। মেয়র বলেন, এই স্কুলটি বাঙালি অধ্যূষিত এলাকায় অবস্থিত এই বিবেচনাও রাখতে হবে। গত সোমবার দেয়া এক বিবৃতিতে মেয়র এসব কথা বলেন।
বিবৃতিতে তিনি বলেন, স্কুলের নাম রাখার বিষয়ে কাউন্সিলের কোন ভূমিকা নেই এবং ওসমানী স্কুলের নাম পরিবর্তনের বিষয়ে আমার কাছে কোন পরামর্শ চাওয়া হয়নি অথবা কোন কিছুই অবহিত করা হয়নি।
মেয়র বলেন, আমার কাছে পরামর্শ চাওয়া হলে বাঙ্গালী কমিউনিটির কাছে এই নামের যে বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে তা তুলে ধরতাম। তাই নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত বাতিলের জন্য স্কুল গভর্ণরদের কাছে আমার দাবী রইলো। তাদের উচিৎ স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিমতকে সম্মান জানানো। এছাড়া বিষয়টি আরো পরিষ্কারভাবে স্কুলের কাছে তুলে ধরার জন্য স্থানীয় অভিভাবকদের প্রতি আমার অনুরুধ রইলো।