সিলেট সিটি করপোরেশন : মেয়র নেই, চলছে আমলা দিয়ে
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ জানুয়ারি ২০১৭, ৯:৪৬ অপরাহ্ণ
উজ্জ্বল মেহেদী ও সুমনকুমার দাশ:
সিলেটে নির্বাচিত মেয়র থেকেও নেই। ভারপ্রাপ্ত মেয়রও নেই। সিটি করপোরেশন চলছে অনির্বাচিত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে। এর ফলে নগরের বাসিন্দারা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
বিএনপির নেতা আরিফুল হক চৌধুরী মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন ২০১৩ সালের ১৫ জুন। ৪২ মাসের মধ্যে মাত্র ৯ মাস চেয়ারে বসতে পেরেছেন তিনি। টানা ২ বছর ৪ দিন কারাগারে থাকার পর বের হলেও দায়িত্ব পাচ্ছেন না। কারণ, কারাবন্দী হওয়ার পরই তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
মেয়রহীন সিলেট সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলররাও স্বস্তিতে নেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কাউন্সিলর প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা জনপ্রতিনিধি, অথচ তাঁদের কাজ করতে হচ্ছে অনির্বাচিত কর্মকর্তার অধীনে। এটা যে কত বড় অসম্মান, তা অন্যরা বুঝবেন না। এ পরিস্থিতি নগরবাসীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনের অনুকূলে নয় বলে মনে করেন তাঁরা। ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রেজওয়ান আহমদ বলেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যে প্রতিষ্ঠানটি চালানোর কথা, সেটি না হওয়ায় একধরনের অস্বস্তি, চাপা ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি হয়েছে।
প্রতিশ্রুতি পালনের কাজ থেমে গেছে
নগরবাসীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে একটি হলো ফুটপাত দখলমুক্ত করে নগরের যানজট নিরসন করা। অপরটি জলাবদ্ধতা নিরসন। প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে পরিচিত নগর দিয়ে প্রবহমান নয়টি ছড়া (খাল) দখল-দূষণে বিপন্ন হওয়ায় প্রতিবছর বর্ষায় দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর এ দুটি অঙ্গীকারপূরণে কাজ শুরু হয়েছিল।
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে টানা এক বছর ১৫ কিলোমিটার ফুটপাতের মধ্যে প্রায় ১০ কিলোমিটার ফুটপাত দখলমুক্ত হয়। নয়টি ছড়া দখলমুক্ত করতে ধারাবাহিক অভিযানের পাশপাশি একই সঙ্গে চালানো হয় খননকাজ। এক বছরের মাথায় যানজট ও জলাবদ্ধতা পরিস্থিতির উন্নতিও হয়েছিল। কিন্তু ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে আরিফুল হক কারাগারে চলে গেলে দৃশ্যপট বদলে যায়।
আরিফুলের নেতৃত্বে ফুটপাত দখলমুক্ত করার পর কেন্দ্রস্থলের মোড় কোর্ট পয়েন্ট থেকে সিটি পয়েন্ট পর্যন্ত যানজট নিয়ন্ত্রণ করতে নির্মাণ করা হয়েছিল ‘রিকশা লেন’। সেটি এখন নেই। ফুটপাত দখল আর দুঃসহ যানজটÑকোর্ট পয়েন্ট থেকে শুরু করে সিটি পয়েন্ট এখন আগের চেহারায়। ছড়া খননকাজ চললেও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দখলমুক্ত করার অভিযান বন্ধ হয়ে পড়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেট শাখার সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, দুই বছরের বেশি সময় ধরে মেয়রবিহীন সিটি করপোরেশন চলছে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছাড়া স্থানীয় সরকারের এত বড় একটি প্রতিষ্ঠানের পথচলা মোটেই সুখকর নয়। যে কাজ জনপ্রতিনিধির করার কথা, সেটা প্রশাসন বা আমলাদের নেতৃত্বে কতটুকু পূরণ করা সম্ভব, এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, মেয়র কারাগারে যাওয়ার পর থেকে দুই বছর ধরে নগরবাসী কোনো বাজেটও পাচ্ছে না। জবাবদিহির চর্চাও নেই। এ অবস্থায় করপোরেশনের আয়-ব্যয়ের হিসাব সম্পর্কেও নগরবাসী ধারণা পাচ্ছে না।
নাগরিক সমস্যা ও ভোগান্তি সিলেটে দুটো ক্ষেত্রে বেশি দৃশ্যমান। একটি ফুটপাত বেদখল, অন্যটি জলাবদ্ধতা। সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরের বন্দরবাজার, জিন্দাবাজার, চৌহাট্টা, সিটি পয়েন্ট, প্রধান ডাকঘরের সম্মুখভাগ, জেল রোড, তালতলা, কিনব্রিজ এলাকা, সুরমা মার্কেট, আম্বরখানা, পাঠানটোলা, সুবিদবাজার, কদমতলী এলাকার ফুটপাতের প্রায় পুরো অংশই হকারদের দখলে রয়েছে। দখল হয়ে পড়া ফুটপাতে শাকসবজি, ফলমূল, কাপড়চোপড়, জুতা, সিডি-ভিসিডি ও প্রসাধন সামগ্রীর বাজার বসেছে।
সিটি করপোরেশনের একজন প্রকৌশলী বলেন, নগরের ২৭টি ওয়ার্ডে নির্মাণাধীন ১৫ কিলোমিটার ফুটপাত রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৯ থেকে ১০ কিলোমিটার ফুটপাত হকারদের দখলে আছে। আবার ফুটপাত ছাড়াও মূল সড়কের আরও অন্তত দুই-তিন কিলোমিটার দখল করে ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করছেন।
দাড়িয়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা সুবিমল দাশ বলেন, আরিফুল হক দায়িত্ব গ্রহণের পর রাতের বেলা বর্জ্য অপসারণ করার ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। এতে করে সকালে অফিস ও স্কুলমুখী লোকজনের ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধ সহ্য করতে হতো না। এখন রাত গড়িয়ে দিনেও বর্জ্য অপসারণ করা হচ্ছে। ফলে উৎকট গন্ধে নগরবাসীকে নাকাল হতে হচ্ছে।
আরিফুল হক ২০১৪ সালে বাজেট পেশ অনুষ্ঠানে নয়টি ছড়ায় ১ হাজার ১০০টি ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা থাকার তথ্য তুলে ধরেছিলেন। এসব স্থাপনা উচ্ছেদ শুরুর আগে দখলদার পক্ষকে নিজে থেকে সরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন তিনি। আরিফুলের এ উদ্যোগ ‘ছড়া-অভিযান’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল। নগরের উত্তরে চা-বাগানের টিলা এলাকা থেকে দক্ষিণে সুরমা নদীর সঙ্গে মিলিত হওয়া গাভিয়ার খাল নামের একটি ছড়া দখলমুক্ত করার কাজ চালানোর সময় সেখানে একজন দখলদার ছড়ার দখল গুটিয়ে উল্টো ছড়ার জন্য জমি দান করেছিলেন।
সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট শাখা জানায়, নয়টি ছড়ার মধ্যে আগেই অন্তত ২৭০টি স্থানে অবৈধ দখল চিহ্নিত হলেও গত দুই বছরে জল্লার খালের ছড়ার একাংশ দখলমুক্ত করা ছাড়া আর কোনো উচ্ছেদ অভিযান চালানো সম্ভব হয়নি।
কেন সম্ভব হয়নি? জানতে চাইলে সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এনামুল হাবীব বলেন, ফুটপাত দখলমুক্ত করা সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এতে জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের উদ্যোগ প্রয়োজন। এমনকি রাজনৈতিক নেতাদেরও সমন্বিত সহায়তার প্রয়োজন। তিনি বলেন, গত দুই বছরে ধারাবাহিকভাবে ফুটপাত দখলমুক্ত অভিযান চালানো হয়েছে। তবে অভিযানের পরপরই আবার বেদখল হতে দেখা গেছে। একইভাবে একাধিক নোটিশ পাঠানোর পরও ছড়ায় অবৈধ দখল গোটানো হয়নি।
এর ফলে নগরবাসী যে সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তা মানতে নারাজ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এনামুল হাবীব। তিনি বলেন, ‘বিশেষ পরিস্থিতিতে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে আমি কাজ করছি। আমরাও চাই, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি করপোরেশন চালান। তবে নাগরিকেরা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, এটি ঠিক নয়। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহতভাবে চলছে।’
প্যানেল মেয়র নিয়ে অচলাবস্থা
আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা মামলায় সম্পূরক অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি হয়ে আরিফুল হক কারাবন্দী ছিলেন ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে। ২ বছর ৪ দিন পর ৪ জানুয়ারি উচ্চ আদালতের আদেশে জামিনে মুক্তি পান তিনি। মেয়র কারাগারে যাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করে। এরপর প্যানেল মেয়র কে হবেন, তা নিয়ে কাউন্সিলররা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়লে দেখা দেয় অচলাবস্থা। সে অবস্থায় মন্ত্রণালয় করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা প্রদান করে।
কিবরিয়া হত্যা এবং বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা পৃথক দুটি মামলায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করলে আরিফুল হকসহ নতুন করে নয়জন অভিযুক্ত হন। একই বছরের ৩০ ডিসেম্বর আরিফুল হবিগঞ্জ আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর থেকে তিনি সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলেন। ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় আরিফুলকে সাময়িক বরখাস্ত করে প্যানেল মেয়র-১ রেজাউল হাসান লোদীকে ওই দায়িত্ব দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, নতুন মেয়র দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম সভাতেই তিন সদস্যের প্যানেল মেয়র তৈরি করা হয়। এই তালিকার এক নম্বরে ছিলেন লোদী। তালিকায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় ছিলেন সালেহ আহমদ চৌধুরী ও রোকসানা বেগম শাহনাজ। তাঁরা তিনজনই বিএনপির সমর্থক।
কিন্তু ২০১৪ সালের ১০ জুন সিটি করপোরেশনের মাসিক সভায় প্যানেল মেয়র হিসেবে কয়েস লোদীর বিরুদ্ধে অনাস্থা এনে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ৩৬ জন কাউন্সিলরের মধ্যে ২৬ জনই এর পক্ষে ছিলেন। মেয়র দায়িত্বে থাকাকালেই এক চিঠিতে তাঁর অনুপস্থিতিতে প্যানেল মেয়র-২ সালেহ আহমদ চৌধুরী দায়িত্ব পালন করবেন বলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়। মেয়রের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রিট আবেদন করেন কয়েস লোদী। মেয়র কারাগারে যাওয়ার পর কে ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পালন করবেন, এ নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে তা আদালত পর্যন্ত গড়ালেও বিষয়টির এখন পর্যন্ত সুরাহা হয়নি। এই সুযোগে সরকার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেয়।
আরিফুলের বিরুদ্ধে যত মামলা
আদালত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কিবিরিয়া হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি মামলাসহ আরিফুল হকের বিরুদ্ধে চারটি মামলা চলমান। সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জনসভায় গ্রেনেড হামলার আরও দুটি মামলায়ও আরিফুল সম্পূরক অভিযোগপত্রে অভিযুক্ত হন। কিবরিয়া হত্যা মামলার বিচারকাজ চলছে। ১৭১ জন সাক্ষীর মধ্যে ৪৩ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন।
আরিফুল হকের আইনজীবী ও সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, দুটি মামলায় আরিফুল এজহারভুক্ত আসামি নন। এ ছাড়া তাঁকে দুটো ঘটনার প্রায় ১০ বছর পর অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে সম্পূরক অভিযোগপত্র দিয়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে। মুফতি হান্নানের জবানবন্দিতে দেওয়া যে নাম থেকে আরিফুলকে জড়ানো হয়েছে, সেই নাম নিয়ে বিভ্রান্তি আছে।
আরিফুলের বরখাস্ত হওয়া প্রসঙ্গে এই আইনজীবী বলেন, সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করে নেওয়ার ব্যাপারে একটি আবেদন করা যেতে পারে। এতে মন্ত্রণালয় সাড়া না দিলে কিংবা বিবেচনায় না নিলে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন করে পুনরায় মেয়র পদে দায়িত্ব পালনের সুযোগ রয়েছে। সূত্রঃ প্রথম আলো