সুনামগঞ্জে জলমহাল দখলে প্রাণ গেল ৩ শ্রমিকের : ৩২ ঘণ্টায়ও হয়নি মামলা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ জানুয়ারি ২০১৭, ৪:৪০ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ:
জলমহাল দখল নিয়ে ক্ষমতাসীনরা এখন দ্বিধাবিভক্ত। তৈরি হয়েছে গ্রুপ উপগ্রুপের। তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বিভিন্ন সময় জলমহালের নীলজল রক্তাক্ত হচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার (১৭ জানুয়ারি) অকালে প্রাণ যায় নিরীহ ৩ শ্রমিকের।
একাধিক গ্রুপে বিভক্ত সুরঞ্জিত অনুসারীদের অভ্যন্তরীণ বিরোধকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা লুটতে চান দীর্ঘদিন সুরঞ্জিত সেনের প্রতিপক্ষ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিউর রহমান। যার জন্য তিনটি খুনের পর ৩২ ঘণ্টা অতিবাহিত হলেও থানায় কোন মামলা হয়নি।
বুধবার (১৮ জানুয়ারি) দিরাই উপজেলা সদরসহ জলমহাল তীরবর্তী গ্রামগুলোর লোকজনের সাথে আলাপকালে এ চিত্র উঠে আসে।
পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে- কোটি টাকার জলমহালকে ঘিরে প্রতি বছরই হাওরজনপদে উত্তেজনা বিরাজ করে। মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির নামে জলমহাল ইজারাপ্রাপ্ত হলেও মৎস্যজীবীদের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। জলমহালে বিনিয়োগকারীরা কোটি টাকার মুনাফা লুটেপুটে খেলেও মৎস্যজীবীদের গতর খাটানো ছাড়া তাদের ভাগ্যে আর কিছুই জুটে না। একপর্যায়ে একাধিক দল ও উপদলে বিভক্ত হয়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে এলাকার ওয়াটার লর্ডরা।
অনেক জলমহাল সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে চলে অবৈধভাবে নিয়ন্ত্রণ। কোটি টাকার জলমহাল নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে সরকারদলের পৃষ্ঠপোষকতায় একাধিক গ্রুপ শক্তির মহড়ায় মরিয়া হয়ে উঠে। এর জের ধরেই ঘটে একাধিক সংঘর্ষ ও বন্দুক যুদ্ধের মত ঘটনা।
বিগত দিনে একাধিক সংঘর্ষের ঘটনায় অনেক লোক হতাহতের শিকার হয়েছেন। জলমহাল দখল-বেদখল নিয়ে এখানে ঘরে উঠেছে একাধিক সন্ত্রাসী গ্রুপ। এখনো আরো কয়েকটি জলমহাল নিয়ে বিরোধ থাকায় ফের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশংকা করছেন হাওর পাড়ের লোকজন।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের হাত ধরে রাজনীতিতে অভিষেক হয় একরার হোসেন ওরফে একরামের। গত ইউপি নির্বাচনে দলীয় সমর্থন না-পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হয় একরার। এরপর থেকে সে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিউর রহমান গ্রুপের সাথে যোগ দেয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সুরঞ্জিত সেন অনুসারীদের কোণঠাসা করার পরিকল্পনায় ব্যস্ত তিনি। গুঞ্জন উঠেছে তিন খুনের মামলায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ রায়, যুগ্ম সম্পাদক ও পৌর মেয়র মোশাররফ মিয়া, উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট সোহেল আহমদসহ সুরঞ্জিত সেনের ঘনিষ্ঠজনদের আসামি করা হচ্ছে।
উপজেলার কুলঞ্জ ইউনিয়নের ঘোরামারা সাতপাকিয়া প্রকাশিত জারলিয়া নদী জলমহাল দখলকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে তিন খুনের ঘটনায় আতংকিত হাওর জনপদ।
জানা গেছে- একরার হোসেনের নেতৃত্বে প্রায় দেড়-দুইশ’ লোক বন্দুক, পাইপগান, সড়কি, লাঠি ইত্যাদি নিয়ে জারলিয়া জলমহাল দখল করতে যায়।
অভিযোগ রয়েছে- জলমহাল দখলের জন্যে সিলেট থেকে তার ছোটভাই এমসি কলেজ ছাত্রদলের আহ্বায়ক বদরুল আজাদ রানা অস্ত্র ও ভাড়াটে সন্ত্রাসী যোগান দেন। এসময় দক্ষিণ নাগেরগাঁও মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক ধনঞ্জয় দাসের লোকজন জলমহালের খলাঘরে অবস্থান করছিলেন। প্রতিপক্ষের লোকজন কাছাকাছি এগিয়ে এলে দুই পক্ষে সংঘর্ষ বাঁধে। এসময় হতাহতের ঘটনা ঘটে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ঘনিষ্ঠ মাসুক মিয়া বলেন- “গত কয়েক দিন ধরে একরার জলমহালটি দখলে নেয়ার চেষ্টা করে। গত মঙ্গলবার একরার তার ভাই ছাত্রদলের ক্যাডার বাহিনী ও এলাকায় তার নিজস্ব বাহিনী নিয়ে তিনদিক থেকে সশস্ত্র আক্রমণ চালায়। তিনি দাবি করেন নিজেদের গুলিতেই ওরা ৩ জন নিহত হয়।”
বিরোধপূর্ণ জলমহালের পাঁচআনা অংশের দাবিদার একরার হোসেন জানান- “স্থানীয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির নামে ১৪২০ বাংলা থেকে পরবর্তী ছয় বছরের জন্য জলমহালটি লিজ আনা হয়। লিজের পিছনে বিনিয়োগ করেন ৫ আনা অংশের মালিক তিনি। লিজ নেয়ার প্রথম বছর শান্তিপূর্ণভাবে ভোগ করলেও পরবর্তীতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ রায় ও যুগ্ম সম্পাদক পৌর মেয়র মোশাররফ মিয়া বিনা পয়সায় অংশিদার করার দাবি করেন।
তাদের অযৌক্তিক দাবি মেনে না-নেয়ায় তারা আমাকে কিভাবে জলমহালটি ভোগ করি তা দেখে নেয়ার হুমকি দিয়েছিল। এর জের ধরেই তারা কৌশলে দক্ষিণ নাগেরগাঁও মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক উমেশ দাসকে বাদ দিয়ে তাদের পছন্দের লোক ধনঞ্জয় দাসকে সাধারণ সম্পাদক পদে নিয়োগ করে। এরপর থেকে আমাকে বাদ দিয়ে পুরো জলমহালটি তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়।”
গত মঙ্গলবার জলমহাল দখলে গেলে তাদের নেতৃত্বে সশস্ত্র হামলা চালালে আমার ১১ জন লোক গুলিবিদ্ধ হয়। এর মধ্যে ৩ জন মারা যায়। সিলেট থেকে তার ছোট ভাই এমসি কলেজ ছাত্রদলের আহ্বায়ক বদরুল আজাদ রানা অস্ত্র ও ভাড়াটে সন্ত্রাসী যোগানদার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।
তবে তার এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও পৌর মেয়র মোশাররফ মিয়া।
তিনি জানান- ঘটনার সময় পৌর সভায় পূর্ব নির্ধারিত আইনশৃংখলা কমিটির সভা ছিল। তিনি কোন জলমহালের ধারে কাছেও যাননি। সংঘর্ষে মেয়রের অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগের ব্যাপারে তিনি জানান- তার আগ্নেয়াস্ত্রটি প্রশাসনের কাছে জমা রয়েছে।
এ ব্যাপারে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ রায় জানান- “একরার গত দুই বছর মৎস্যজীবীদের লিজ নেয়া জলমহালটি জোরপূর্বক ভোগ করে আসছিল। এ নিয়ে মামলা মোকদ্দমাও হয়। এক পর্যায়ে মৎস্যজীবীরা জলমহালটি ফিরে পেলে কর্তৃত্ব হারায় একরার। এরপর থেকে জলমহালটি দখলে নিতে মরিয়া হয়ে উঠে সে। এর ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার সশস্ত্র লোকজন নিয়ে জলমহালটি দখলে গেলে মৎস্যজীবীরা প্রতিরোধ করে।”
ঘটনার সাথে তার সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করে তিনি বলেন- ১৬ জানুয়ারি থেকে ঢাকায় অবস্থান করছেন।
সরেজমিনে নিহতদের গ্রামের বাড়ি আকিলনগরে গেলে দেখা যায় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যে বিরাজ করছে।
শাহরুলে মা পুত্র হারানোর শোকে বিলাপ করছেন, তার স্ত্রী সাহেনা বেগম অনেকটা বাকরুদ্ধ। ঘরে তাকে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে। জ্ঞান ফিরলেই স্বামীর হারানোর শোকে চিৎকার করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন, বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন কথা বলতে পারছেন না।
শাহরুলের মা সেলিনা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন- “ঘটনার দিন আমার ছেলেকে উজ্জ্বল ফোন করে নিছে। যাওয়া মাত্র শুনি আহাদের পার্টির লোক আমার ছেলেরে গুলি করে মারছে।”
উজ্জ্বলের স্ত্রী সাহানা ১ বছরের পুত্র সন্তানকে কোলে নিয়ে বিলাপ করছিলেন। এসময় তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন- আমার স্বামী হাতিয়া গ্রামের দবির মিয়ার বাড়িতে চাকরি করেন। ঘটনার দিন জারলিয়া নদীর পাশের জমিতে কাজ করতে গেলে বিলের মালিকরা আমার স্বামীকে গুলি করে মারে।”
জারলিয়া নদী তীরবর্তী আকিলনগর গ্রামের বাসিন্দা প্রত্যক্ষদর্শী নিহত শাহরুলে চাচা ইব্রাহিম মিয়া, নিজাম উদ্দিনসহ গ্রামের একাধিক নারীপুরুষ বলেন- “ঘটনার দিন সকালে একরার তার লোকজন নিয়ে এক বৈঠক করছিলেন। বৈঠক চলাকালে প্রতিপক্ষরা জলমহালে মাছ ধরছেন, এমন খবর পেয়ে একরাররে লোকজন বাধা দিতে আনন্দনগর পাড়ার পাশে গেলে প্রতিপক্ষ কুলঞ্জের মাসুক মিয়া, এহিয়া চৌধুরী, কাদির মিয়া, হাতিয়া গ্রামের আহাদ মিয়া ও টংগর গ্রামে কাওসার, সাদ্দাম, সুরয়িারপারের আরেক সাদ্দাম, আকিলনগরের তাজ উদ্দিনরা অতর্কিত গুলি চালায়।”
মঙ্গলবার জলমহাল দখলকে কেন্দ্র করে স্থানীয় যুবলীগ নেতা একরার বাহিনী ইজারাদার ধনঞ্জয় দাসের পক্ষে স্থানীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা মাসুক মিয়া, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আহাদ মিয়া ও অরিফুজ্জামান এয়াহিয়া চৌধুরী গংদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে হাতিয়া গ্রামের ছানা উল্যার ছেলে তাজুল ইসলাম (৩৫) ঘটনাস্থলে, আকিল নগর গ্রামের ইসহাক মিয়ার ছেলে শাহরুল (২৮) ও একই গ্রামের আমান উল্লার ছেলে উজ্জ্বল (২৫) নিহত হয়।
গতকাল বিকেলে পুলিশ নিহতদের ময়না তদন্ত শেষে স্বনদের কাছে লাশ হস্তান্তর করে। সন্ধায় আকিলনগর গ্রামে জানাজা শেষে উজ্জ্বল ও শাহরুলের লাশ দাফন করা হয়। হাতিয়া গ্রামে তাজুলের লাশ দাফন করা হয়।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে- জারলিয়া নদী তীরবর্তী আকিল নগর গ্রাম। এ গ্রামে একরারে একক আধিপত্য ও তার গোষ্ঠীর লোকজন রয়েছে। এ গ্রামে ঘটনার দিন একরার তার বাহিনীর লোকজন নিয়ে বৈঠক করে জলমহাল দখল করতে যায়, জলমাহালের তীরবর্তী আনন্দপুর গ্রামের পাশে গেলে খলাঘরে অবস্থান নেয়া আওয়ামী লীগ নেতা মাসুক মিয়া, আরিফুজ্জামান চৌধুরী এহিয়া, কুলঞ্জ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল আহাদ, কাওসার ও তার বাহিনীর লোকজনসহ তাদেরকে প্রতিহত করতে চাইলে সংঘর্ষ বাঁধে।
দিরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল জলিল জানান- বুধবার (গতকাল) পুলিশ সুপার হারুন আর রশিদ, সিলেট রেঞ্জ অফিসের এসপি নুরুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দিরাই সার্কেল বেলায়েত হোসেন সিকদার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। গতকাল (বুধবার) সন্ধ্যা ৭টায় রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এ ঘটনায় কোন মামলা হয়নি।
গ্রেফতার ও অস্ত্র উদ্ধার নেই। এ ব্যাপারে পুলিশের অভিযান চলছে বলে তিনি জানান। বিরোধপূর্ণ জলমহালের খলায় পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে আগ্নেয়াস্ত্রের ৬টি খোসা উদ্ধার করা হয়েছে।