মৃত্যুক্ষুধা : নজরুল সাহিত্যের ভিন্ন মেজাজ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ জানুয়ারি ২০১৭, ৭:৪০ পূর্বাহ্ণ
ড. অরিজিৎ ভট্টাচার্য: কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের একটি স্মরণীয় নাম। কিন্তু তুলনামূলকভাবে নজরুল যেখানে অনুচ্চারিত, উপেক্ষিত রয়েছেন সেটি হচ্ছে তাঁর কথা সাহিত্য। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না । একটা সময় ছিল যখন সৌন্দর্য-সৃষ্টি ও আনন্দ দানই ছিল শিল্প সাহিত্যের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। এমন সাহিত্যকে বলা হতো নন্দনতাত্ত্বিক সাহিত্য। পরবর্তীকালে কার্ল মার্কসের অর্থনৈতিক চিন্তাধারা, ফ্রয়েডের মনোবিকলনবাদ ও জৈবিক চেতনা আধুনিক লেখক সমাজের মনোজগতকে প্রচণ্ডভাবে ঝাঁকুনি দিয়েছে। বর্তমান লেখকবৃন্দ নন্দনতাত্ত্বিকতাকে একেবারে পরিহার না করলেও রূঢ় বাস্তবতাকে কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারেন না। এরই ফলে সুন্দরের সাথে অসুন্দরের, সুনীতির সাথে দুর্নীতি, দয়ার্দ্রতার সাথে নিষ্ঠুরতা সাহিত্যে উঠে আসে সমান গুরুত্ব নিয়ে। এর সাথে উঠে আসে নরনারীর জৈবিক তাড়না ও নানা টানাপোড়েন। এসবতো জীবনেরই অবশ্যম্ভাবী চেতনার বহিঃপ্রকাশ। আসল কথা এই যে, অর্থ ও জৈবিক তাড়না মানুষের অন্য প্রায় সকল চেতনার নিয়ামক ও নিয়ন্ত্রক। ঔপন্যাসিকদের মধ্যে এই প্রবণতা দেখা দেয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে। ফ্রয়েড ও মার্কসের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী এই প্রবণতা দানা বাঁধে। বাংলাদেশে মার্কসবাদ তথা সমাজবাদের প্রবক্তা ছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মোজাফ্ফর আহমদ। অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই বন্ধুর উপর পড়ে বন্ধুর প্রভাব। কাব্যে সাম্যবাদী কবিতাগুচ্ছ ও আরো অনেক কবিতায় এ প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসেও সর্বহারাদের জীবন নিয়েই নজরুল শুরু করেছিলেন, যদিও শেষ পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করতে পারেননি।
‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে। কৃষ্ণনগরে অবস্থানকালে নজরুল এ উপন্যাসটি রচনা করেন। এই উপন্যাসে নজরুলের যাপিত জীবনের কিছু ঘটনা ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অনেকখানি ছায়াপাত ঘটেছে। ১৯২৭ থেকে ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ‘মৃত্যুক্ষুধা’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় সওগাত পত্রিকায়। নজরুল ১৯২৬ থেকে ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কৃষ্ণনগরের চাঁদ সড়কের ধারে একতলা এক বাংলো প্যাটার্নের বাড়িতে বাস করতেন। কবি এ সময় কঠিন দারিদ্র্য-দুঃখে নিপতিত হয়েছিলেন। প্রকাশকদের অসহযোগিতা ও হৃদয়হীনতাই নজরুলের অসহ অনটন ও অর্থকষ্টের কারণ হয়েছিল। নজরুলের বই বিক্রয় করে প্রকাশকরা ফুলে ফেঁপে উঠেছেন আর নজরুল অভাব ও কষ্টের সমুদ্রে হাবুডুবু খেয়েছেন। তাঁর সুবিখ্যাত ও বহুপঠিত কবিতা ‘দারিদ্র্য’ এই সময়েরই রচনা।
‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসের পটভূমি কৃষ্ণনগরের চাঁদ সড়কের এক বস্তি এলাকা। এখানে বাস করে এক দরিদ্র মুসলিম পরিবার। বৃদ্ধা মা, তিনটি বিধবা পুত্রবধূ ও তাদের কয়েকটি সন্তান। আবার ঊনিশ বছরের একটি ছেলে, স্বামীর বাড়ি ফেরৎ একটি মেয়ে নিয়ে তার হতদরিদ্র সংসার। বৃদ্ধার ছেলের নাম প্যাঁকালে। প্যাঁকালের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের ফলেই এই সংসারটি টিকে আছে কোনো রকমে। সে ভালোবাসে কুশি নামে এক খ্রিস্টান মেয়েকে। কুশিও ভালোবাসে প্যাঁকালেকে। এই দরিদ্র পরিবারের সাথে আর একটি কাহিনি এসে জুড়েছে। প্রথম কাহিনিতে মৃত্যু আছে, ক্ষুধাও আছে কিন্তু দ্বিতীয় কাহিনিতে মৃত্যু আছে, ক্ষুধা নেই। দ্বিতীয় কাহিনিটি সংসার-বিবাগী দেশপ্রেমিক বিপ্লবী আনসারের। আনসার ভালোবাসতো ময়মনসিংহের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কন্যা রুবীকে। রুবীও ভালোবাসতো তাকে। কিন্তু মা-বাবা রুবীকে বিয়ে দেয় এক অর্থ লোলুপ যুবকের সাথে। রুবী তাকে স্বামী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। অবশ্য অল্পদিনের মধ্যেই রুবীর স্বামী মৃত্যুবরণ করে। আনসার রাজবন্দী অবস্থায় ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়। রুবী এ সংবাদ পেয়ে ছুটে যায় আনসারের কাছে। আনসার মৃত্যুবরণ করে ক্ষয়রোগে। কাহিনি শেষ হয় একই রোগে রুবীর আসন্ন মৃত্যুর ইঙ্গিতে দিয়ে।
‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসে অঙ্কিত হয়েছে নজরুল জীবন-চিত্র। প্রথম অংশে কিশোর আর দ্বিতীয় অংশে যুবক নজরুল প্যাঁকালে চরিত্র প্রতিনিধিত্ব করেছে নজরুলের কৈশোরক জীবনকে, আর আনসার করছে নজরুলের পরিণত ও আদর্শায়িত জীবনকে। তবে তুলনামূলকভাবে পঁ্যাকালে চরিত্র অনেক বেশি উজ্জ্বল ও বাস্তব। প্যাঁকালে টাউনের থিয়েটার দলে নাচে, সখীসাজে গান করে, কাজও করে- রাজমিস্ত্রির কাজ। বাবুঘেঁষা হয়ে সেও একটু বাবু গোছের হয়ে গেছে। টেরি কাটে, সিগারেট টানে, পান খায়, চা খায়। পাড়ার মেয়ে মহলে তার মস্ত নাম। বলে- যেমন গলা তেমনি গান, তেমনি সৌখিন। থিয়েটারে নাচে, বাবুদের থিয়েটার । মুহূর্তেই আমাদের মনে পড়ে যায় লেটোর দলের গান লেখক গায়ক অভিনেতা নজরুলকে। প্যাঁকালে গভীর সহানুভূতিশীল ও বিবেচক। পুরো সংসারটা তার ঘাড়ের উপর। একটা আয়না কেনার জন্যে রোজ সে চার আনা পয়সা রাখে। কিন্তু বাজার করতে গিয়ে যখন দেখে ছ আনায় সকলের খাবার মতো চালই পাওয়া যায় না তখন বাধ্য হয়ে লুকোনো সিকিটা বের করতে হয়। প্যাঁকালে জীবন ও জীবিকার তাগিদে খান সাহেবের বাড়িতে কুড়ি টাকায় চাকরি নিয়েছিল। যেমন নজরুলও খ্রিস্টান গার্ড সাহেবের ‘বয়’-এর চাকরি নিয়েছিলেন পঁচিশ টাকায়। প্যাঁকালে (ওমান কাতলি (রোমান ক্যাথলিক) শিমধু ঘরামির কন্যা কুর্শিকে) ভালোবেসেছিল। এই ভালোবাসাকে সার্থক করার জন্য সে ধর্মান্তরিত হতেও দ্বিধা করেনি। অবশ্য সে শেষ পর্যন্ত ফিরে এসেছে সস্ত্রীক স্বধর্মে।
‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসের একটি অনন্য সাধারণ চরিত্র মেজবৌ। মেজবৌ অত্যন্ত সুন্দর দেহে যেমন মনেও তেমনি। অত্যন্ত উদার হৃদয়, স্নেহপ্রবণ, সহানুভূতিশীল। দারিদ্র্যের দগ্ধ মরুতে সে যেন এক সুশীতল মরুদ্যান। দরিদ্র ঘরের রূপসী বিধবার প্রতি লালসা আর কামনার দৃষ্টি কটাক্ষ, হাতছানি চারদিকে। এসব থেকে নিজেকে অত্যন্ত কৌশলে বাঁচিয়ে রেখেছে। এ চরিত্রটি অপার সম্ভাবনা নিয়ে শুরু হয়েছিল। তাঁর অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বহির্দ্বন্দ্ব উপন্যাসের উৎকর্ষকে অন্য মাত্রা দেবার সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু নজরুল সে পথে যান নি। যথেষ্ট কারণ ছাড়াই ঔপন্যাসিক মেজবৌকে ধর্মান্তর করালেন। সে ছেলেমেয়ের খাওয়া-পরার জন্য খ্রিস্টান হলেন, তাদেরকে ফেলে রেখে চলে গেলেন অনেক দূরে- বরিশালে। আবার ছেলের অসুখের সংবাদ জেনে ফিরে এলেন বাড়িতে। ধর্মান্তরিত না হয়েও মুসলমান বাড়িতে কোনো খ্রিস্টান মহিলা দিনের পর দিন অবস্থান করতে পারেন কিনা এ কথাও ঔপন্যাসিক ভেবে দেখেননি। মেজবৌকে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীকান্ত উপন্যাসের কমললতার সাথে তুলনা করা যায়। রাজলক্ষ্মী যেন রুবী। আর কমললতা মেজবৌ। সাদৃশ্যটি দূরবীক্ষণীয় হলেও একেবারে দুর্লক্ষ নয়। আনসার চরিত্রটি নজরুলের পরিণত বয়সের প্রতিরূপ। এখানে আমরা পাচ্ছি সংসার বিরাগী ধ্যানী, শিল্প প্রেমিক, সর্বোপরি বিপ্লবী স্বদেশ প্রেমিক নজরুলকে। মানুষের জন্য জাতির জন্য, দেশের জন্য আনসার সর্বত্যাগী হয়েছে। এমনকি নিজের জীবনও সঁপে দিয়েছে মৃত্যুর নির্মম শীতল হাতে। সে নজরুলের যোগ্যতম প্রতিনিধি।
‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসের প্রথম অংশে যে ঘটনাবলি দেখতে পাই এবং যে জীবন স্পন্দন অনুভব করি তা বাস্তব জীবন থেকে আহরিত। ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসে চাঁদসড়কের কতকগুলো সত্যিকার চরিত্র কেবল নাম বদলে ব্যবহার করা হয়েছে। গজালের মার আসল নাম ছিল হবির মা। তাঁর তিন ছেলে- বড় নূর মোহাম্মদ, মেজো হাবিব ও ছোট করিম (প্যাঁকালে), মেজো ছেলে হাবিবের স্ত্রীই মেজবৌ। রোমান ক্যাথলিক পাড়ার হিড়িম্বার সত্যিকার নাম কামিনী।
নজরুল প্রধানত রোমান্টিক কবি। কাব্যের ভাষায় তাই অলঙ্কার ব্যবহার স্বভাবজ। কিন্তু ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসে গদ্য ভাষা ব্যবহারের বিশিষ্টতা এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। উপমা-উৎপ্রেক্ষা, যমক শ্লেষ প্রভৃতি অলঙ্কারের অনায়াস প্রয়োগ এ উপন্যাসের ভাষাকে এক অসাধারণ ঔজ্জ্বল্যে উদ্ভাসিত করে তুলেছে। কয়েকটি উদ্ধৃতি স্মরণ করে নেওয়া যেতে পারে,
১। “সেজবৌ পাশ ফিরে কাশতে থাকে। মনে হয় ওর প্রাণ গলায় এসে ঠেকেছে। কবর দেবার জন্য বাঁশ কাটার শব্দটা যেমন ভীষণ করুণ শোনায় তেমনি তার কাশির শব্দ ।”
২। “ভোর না হতেই সেজ বৌ’র খোকা সেজ বৌ’র কাছে চলে গেল। শবে বরাত রজনীতে গোরস্থানের মৃতপ্রদীপ যেমন ক্ষণেকের তরে ক্ষীণ আলো দিয়ে নিবে যায়। তেমনি ।”
এছাড়া মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসে নজরুল স্থানীয় পরিবেশ নির্মাণে আশ্চর্য দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। ব্যক্তি অনুযায়ী মুখের ভাষা, অবস্থা অনুযায়ী পরিচ্ছদ ও আচরণ-উচ্চারণ, এমনকি মিশনারীদের মুখে বাংলা ভাষায় ইংরেজি টানটিও যথাযথ রেখেছেন।
‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসের শিল্পসিদ্ধি সম্পর্কে আলোচনা এই প্রবন্ধের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। এই আলোচনা প্রসঙ্গে অন্য একটি বিষয়ে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বিশ্বের চিন্তাজগতেও বিপ্লবের জন্ম দিয়েছিল। এর প্রভাবে সাহিত্যে প্রভাব ফেললো বস্তুতান্ত্রিকতা। শিল্পের জন্যই শিল্প নয়। মানুষের জন্যই শিল্প। সাহিত্যে খেটে খাওয়া কর্মজীবী মানুষের অনাড়ম্বর ও অভাব অনটনে পর্যুদস্ত জীবনচিত্র ফুটে উঠলো। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এ প্রবণতার ব্যতিক্রম হলো না। এ প্রবণতারই অন্যতম প্রথম রূপকার কাজী নজরুল ইসলাম। ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসটি এই মন্তব্যের সপক্ষে প্রকৃষ্ট উদাহরণ। উৎকর্ষের বিচারে না হলেও এদিক থেকে উপন্যাসটির ঐতিহাসিক মূল্য সমধিক এবং অবশ্যই মূল্যায়নের দাবি রাখে।
গ্রন্থ ঋণ –
১। অরুণ কুমার বসু : নজরুল জীবনী
২। আজহারউদ্দীন খান : বাংলা সাহিত্যে নজরুল
৩। বিশ্বনাথ দে (সম্পাদিত) : নজরুল স্মৃতি
৪। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় : কেউ ভোলে না কেউ ভোলে
৫। সুশীলকুমার গুপ্ত : নজরুল–চরিত মানস